জেলা হাসপাতালগুলোর আইসিইউ'র জন্য সাত বছরের অপেক্ষা
২০১৪ সালের নভেম্বরে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম সংসদে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, চলতি মাস থেকেই জেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ ও হৃদরোগীদের জন্য সিসিইউ স্থাপন কার্যক্রম শুরু হবে। এরপর সাতবছর কেটে গেলেও তা এখনো শুরু হয়নি।
গতবছর করোনাভাইরাস সংক্রমণের সময় আইসিইউ এর অভাবে কোভিড ও নন-কোভিড রোগীদের মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকলে বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় দু'টি প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) চূড়ান্ত অনুমোদনকালে গত জুনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব জেলা সদর হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট স্থাপনের নির্দেশ দেন। কিন্তু এখনও এ কাজ শুরু হয়নি।
কোভিড ভ্যাকসিন কেনাসহ জেলা হাসপাতালে আইসিইউ বেড স্থাপনে গত জানুয়ারিতে ৬,৬১৪ কোটি টাকা ব্যয়ের সংশোধিত একটি প্রকল্প অনুমোদন করেছে একনেক।
সরকারী হাসপাতালের যন্ত্রপাতি মেরামত এবং আইসিইউ, ভেন্টিলেটর, অক্সিজেন লাইন স্থাপন করার জন্য ন্যাশনাল ইলেকট্রো-মেডিকেল ইকুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স ওয়ার্কশপ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার (নিমিউ অ্যান্ড টিসি) নামে যে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান আছে, দেশে করোনা সংক্রমণের আগে তা কারও জানা ছিল না।
কোভিড পরিস্থিতিতে সারাদেশের সরকারি হাসপাতাগুলোতে জরুরিভিত্তিতে আইসিইউ, ভেন্টিলেটর মেরামত ও স্থাপন এবং সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্ল্যান্ট স্থাপনের দায়িত্ব পরে নিমিউ অ্যান্ড টিসির ওপর।
কিন্তু ৬২০টি হাসপাতালের যন্ত্রপাতি মেরামতের দায়িত্বপ্রাপ্ত এ প্রতিষ্ঠানটির জন্য কোন যানবাহন নেই, ১৫ ইঞ্জিনিয়ারসহ মোট জনবল ৮৩ জন। এসব কাজ করতে আরও প্রায় ৮০০ জনবল নিয়োগের প্রস্তাব স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে পাঠিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি, যা এখনও অনুমোদন পায়নি। ২৬টি হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন স্থাপনের কাজ গত বছরের মাঝামাঝিতে শুরু হলেও মাত্র ১৪টির কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি ১২টির মধ্যে কোনটির ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছে, কোনটির স্থান নির্বাচনের কাজ চলছে।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তিখাতের গবেষণার উন্নয়নে ১০০ কোটি টাকার একটি 'সমন্বিত স্বাস্থ্য-বিজ্ঞান গবেষণা ও উন্নয়ন তহবিল' গঠনের প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। গত বছর নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অনুমোদন নিয়ে এই তহবিল পরিচালনার জন্য স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ ড. কাজী দ্বীন মুহাম্মদকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠনসহ তহবিল পরিচালনার নীতি তৈরি করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে অর্থমন্ত্রণালয়। অর্থবছর শেষ হতে চললেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এখনও তার সার্কুলার ইস্যু করেনি।
প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ এসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা জানান, কোভিড মহামারীতে স্বাস্থ্যখাতে বেসরকারি হাসপাতালগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে এ খাতে বেসরকারিখাতের বিনিয়োগ ছিল স্থবির।
অন্যদিকে চলতি অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ তিন হাজার কোটি টাকা বাড়ায় অর্থ মন্ত্রণালয়। রাজস্ব আয় কমে যাওয়ার আশঙ্কায় অর্থবিভাগ সব মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন বরাদ্দের সরকারি (জিওবি) অংশে ২৫ শতাংশ কমালেও স্বাস্থ্যখাতের বরাদ্দ কমানো হয়নি। কিন্তু সক্ষমতার অভাবে এবারও তা ব্যয় করতে পারছে না স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
চলতি ২০২০-২১ অর্থবছর স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের অনুকূলে এডিপিতে বরাদ্দ রয়েছে ৯,৭৩৬ কোটি টাকা, জুলাই-জানুয়ারি সময়কালে ব্যয় হয়েছে মাত্র ১,৬৫৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ, অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে উন্নয়ন ব্যয়ের মাত্র ১৭ শতাংশ ব্যয় করতে পেরেছে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ।
অন্যদিকে, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের অনুকূলে চলতি অর্থবছর উন্নয়ন বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২,২৭৭ কোটি টাকা। গত জানুয়ারি পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৬৩২ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের প্রায় ২৮ শতাংশ।
স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, কোভিড মোকাবেলায় বিশ্বব্যাক ও এডিবির অর্থায়নে শুরু হওয়া প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার দু'টি প্রকল্পের আওতায় গগলস, পিপিইসহ বিভিন্ন কেনাকাটায় আর্থিক অনিয়ম করায় প্রকল্প দু'টির পিডি মো. ইকবাল কবিরকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করে সরকার। পাশাপাশি স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি বিরোধী অভিযান চলে কিছুদিন। তারপর থেকেই স্বাস্থ্যখাতের বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি শুরু হয়েছে।
তারা জানান, স্বাস্থ্যখাতের প্রকল্পগুলোর কেনাকাটায় আগে বড় ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি হতো। ফলে প্রকল্পের পিডি হওয়া কিংবা দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্য হওয়ার জন্য কর্মকর্তাদের অনেকে মুখিয়ে থাকতেন। কিন্তু এ খাতে দুর্নীতি বিরোধী অভিযান চলার পর থেকে প্রকল্পগুলোতে পিডি হওয়ার আগ্রহ কমে গেছে, দরপত্র মূল্যায়ন কমিটিতে থাকতে চান না কর্মকর্তারা। মন্ত্রণালয় থেকে কমিটিতে কর্মকর্তাদের নাম দেওয়া হলেও তারা কমিটির সভায় উপস্থিত হন না।
স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা) মো. হেলাল উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, কোভিড মোকাবেলায় নেওয়া প্রকল্পের প্রথম পিডির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে ওএসডি করার পর ওই প্রকল্পে দু'জন পিডি নিয়োগ দেওয়া হলেও তারা কোন কাজ করেননি। তবে পরে যে পিডি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তিনি সঠিকভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছেন। এ প্রকল্পের আওতায়ই জেলা হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ বেড স্থাপন করা হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ত্বড়িৎ গতিতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার কারণে পর্যায়ক্রমে এসব পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। জরুরি প্রয়োজন মেটাতে নতুন করে তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসক, নার্স নিয়োগ ও আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
কোভিড পরিস্থিতিতে জরুরি প্রয়োজন মেটাতে ২০০০ ডাক্তার, ৬ হাজার নার্স নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে ৩৮৬ জন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, ২৬৫৪ জন ল্যাব এটেন্ডেন্ট নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া, রাজস্বখাতে ১২০০ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, ১৬৫০ মেডিকেল টেকনিশিয়ান এবং ১৫০ কার্ডিওগ্রাফারসহ ৩০০০ নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়েছে বলে বাজেট বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন অর্থমন্ত্রী। আরও ডাক্তার নিয়োগে বিশেষ বিসিএস নেওয়া হচ্ছে, ৩০০০ টেকনোলজিস্ট নিয়োগের প্রক্রিয়াও চলছে। তা সত্ত্বেও হাসপাতালগুলোতে রোগী অনুপাতে ডাক্তার, নার্সের ঘাটতি থাকবে। বিশেষ করে, ডাক্তার অনুপাতে নার্সের সংখ্যা অনেক কম।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গত এক বছরে সরকার কোভিড নিয়ন্ত্রণে পুরোপুরি মনোনিবেশ করায় এই রোগ নিয়ন্ত্রণে সাফল্য এসেছে। সফলভাবে ভ্যাকসিনেশন কর্মসূচি বাস্তবায়ন হচ্ছে। তবে সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্যসেবায় যে দৈন্যদশা ছিল, তার খুব বেশি উন্নয়ন হয়নি। স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি দমনে অভিযান চলার সময় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপের মুখে শেষ পর্যন্ত তা বন্ধ করে দিতে হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক মুজাহেরুল হক বলেন, 'করোনাভাইরাস আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সংস্কারের শিক্ষা দিয়েছে। মহামারীতে জনবল নিয়োগ, অক্সিজেন লাইন স্থাপনসহ অবকাঠামোগত কিছু উন্নয়ন হয়েছে। তবে চিকিৎসা সেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। স্বাস্থ্যখাতের বিকেন্দ্রীকরণ হয়নি'।
'আমাদের কমিউনিটি ক্লিনিক অনেক ভালো করছে কিন্তু ইউনিয়ন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র তেমন কার্যকরী নয়। উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসার উন্নত ব্যবস্থা করতে হবে। সেখান থেকে শুধু আইসিইউ এর প্রয়োজন হলে জেলা বা বিভাগীয় শহরে যাবে রোগীরা। রেফারেল সিস্টেম কার্যকর করতে হবে। তাহলে রোগীর ভোগান্তি ও অর্থিক খরচ কমবে; রাজধানীর হাসপাতালগুলোর ওপরও চাপ কমবে', যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, 'করোনাভাইরাস আমাদের চিকিৎসা সক্ষমতা বাড়িয়েছে।করোনাভাইরাসের চিকিৎসার জন্য হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যালুনা, সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন স্থাপন করা হয়েছে অনেক হাসপাতালে। চিকিৎসক, নার্স, টেকনোলজিস্টসহ কয়েক হাজার জনবল নিয়োগ দেয়া হয়েছে। চিকিৎসকদের জন্য আরেকটি বিশেষ বিসিএস নেয়ার প্রস্তুতি চলছে। স্বাস্থ্য খাতে অনেক দিন জনবল নিয়োগ বন্ধ ছিলো। করোনার কারণে জনবল সংকট কিছুটা কাটছে। তারপরও ডাক্তার-নার্স অনুপাত কমাতে উদ্যোগ নিতে হবে'।
তিনি বলেন, 'জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম) এবং রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) বেশ কিছু গবেষণা করেছে। তবে আমরা গবেষণায় অনেক পিছিয়ে। গবেষণায় আরো জোর দিতে হবে। করোনাভাইরাস চলে গেলেও আরো ইমার্জিং এবং রি-ইমার্জিং ডিজিজ আসতে পারে। সেজন্য গবেষণা অনেক জরুরি'।
কোভিড সংক্রমণের আগে, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে প্রতিটি বিভাগীয় শহরে অবস্থিত মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০০ শয্যা বিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ ক্যান্সার চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপনে ২৩৮৮ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয় একনেক। ক্যান্সার চিকিৎসা কেন্দ্রের ভবনগুলোতে হার্টের রোগীদের চিকিৎসার জন্য তিনটি ফ্লোর বরাদ্দ থাকার কথা রয়েছে।
এছাড়া, প্রতিটি বিভাগীয় শহরে নিউরো হসপিটাল এবং জেলা সদর হসপিটালে ৫ বেড এবং মেডিকেল কলেজ হসপিটালে ৫০ বেডের কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার স্থাপনের উদ্যোগ রয়েছে সরকারের। সারাদেশের সরকারি হাসপাতালের মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্ল্যান্ট স্থাপনে একটি প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ।
সেবা বিভাগের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, এসব পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল দেশে কোভিড সংক্রমনের আগেই। এর সুফল পেতে আরও অপেক্ষা করতে হবে।