জৈব কৃষি ও জৈবিক বালাই দমন ব্যবস্থাপনায় সফল ত্রিশালের পাঁচশ কৃষক
আবুল হাসেম ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার রামপুর এলাকার একজন সবজি চাষী। সবসময় রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করে সবজিচাষ করেন তিনি। তবে এবার স্থানীয় কৃষি অফিসের সহযোগীতায় তিনি পরিবেশবান্ধব কৌশলের মাধ্যমে নিরাপদ ফসল উৎপাদন করছেন। ২৬ শতাংশ জমিতে বাধাকপি চাষ করেছেন তিনি। যেখানে ব্যবহার হচ্ছে না কোনো কীটনাশক বা রাসায়নিক সার। আবুল হাসেম জানাচ্ছেন পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে ফসল উৎপাদনে ২৬ শতাংশ জমিতে বাঁধাকপি চাষে তার খরচ হয়েছে ৮ হাজার টাকা। এই চাষে তাকে প্রযুক্তি, ফসলের বীজ ও জৈবসার সরবরাহ করেছে স্থানীয় কৃষি বিভাগ। তিনি এবার এখান থেকে প্রায় ৫০ হাজার টাকার বাঁধাকপি বিক্রি করবেন বলেন জানান।
এদিকে ফসলের ক্ষেতে রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক ব্যবহারের ফলে পরিবেশের ভারসাম্যই বিনষ্ট হচ্ছে না সাথে চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে মানুষ। যত দিন যাচ্ছে পোকার দেহেও বালাইনাশকের প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হচ্ছে, ফলে বাড়াতে হচ্ছে বিষ ব্যবহারের পরিমান। এটা মাথায় রেখেই সারা দেশে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর পরিবেশবান্ধব অর্গানিক নিরাপদ ফসল উৎপাদনে কাজ শুরু করেছে। এ আওতাতেই ময়মনসিংহের ত্রিশালে এবার রবি শস্যে পরিবেশবান্ধব কৌশল ব্যবহার করে সফলতা পেয়েছেন প্রায় ৫'শ চাষী। আবুল হাসেমের মতো ত্রিশালের পাঁচশ কৃষক একইভাবে মোট একশ একর জমিতে করেছেন রবি শস্যের চাষ। যেখানে আছে টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, বেগুন, শসা, মরিচ, লাউ ইত্যাদি।
ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলায় রামপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায় ফসলের ক্ষেত ঢেকে রাখা হয়েছে নেট দিয়ে তৈরি চার কোনা ঘরে। বাঁশ ও নেটের তৈরি এসব ঘরের ভিতরে কাজ করছে চাষী। গ্রামের ফসলের মাঠে এমন চিত্র অনেকটাই অপরিচিত। ব্যবহার হচ্ছে না কোন রাসায়নিক সার কিংবা কীটনাশক । ক্ষতিকর পোকামাকড় দমনের জন্য রাসায়নিক কীটনাশকের পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে সেক্স ফেরোমোন ফাঁদ, হলুদ আঠালো ফাঁদ, নেট হাউজ, জৈব বালাইনাশক।
টমেটো চাষী ইউসুফ আলী বলেন, "সাধারণত তিনশ টাকা করে একবোতল কীটনাশক কিনে এনে ক্ষেতে ছিটাই। নিয়মিতই এসব কীটনাশক ব্যবহার করে এসেছি। এখন হলুদ কাগজের মতো এক ধরেনের আঠালো ফাঁদ ব্যবহার করছি পোকা সেখানে আটকে থাকে। সাথে সেক্স ফেরোমোন ফাঁদ ব্যবহার করছি এতে ক্ষতিকারক পোকা দমন হচ্ছে। প্রায় ত্রিশ শতাংশ জমিতে আমি টমেটো চাষ করেছি। খরচ হচ্ছে প্রায় ৪০ হাজার টাকার মতো। আশা করছি ৭০ মন টমেটো আমি এখান থেকে বিক্রি করতে পারবো। যা বিক্রি করে প্রায় ৮৫ হাজার টাকার মতো আসবে"।
স্থানীয় কৃষক আব্দুল মোতালেব বলেন , "ক্ষেতে যে এত ধরনের পোকা থাকে আমার ধারনা ছিলো না। এখন ফাঁদে আটকা পড়া শত শত পোকা নিজ চোখে দেখছি। জমিতে আগের মতো আমরা সার ব্যবহার করি না। এবার ভার্মি কম্পোস্ট ব্যবহার করেছি। স্থানীয় কৃষি অফিস এসব সারের যোগান দিয়েছে"। তিনি জানান এবার এই পদ্ধতিতে ১৬ শতাংশ জমিতে শীত লাউ চাষ করেছেন । ১৫ হাজার টাকা খরচ করে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকার লাউ বিক্রি করবেন তিনি।
কীটনাশক ছাড়া পোকা দমন ও জৈব প্রযুক্তিতে উৎপাদনে কৃষকদের পাশে রয়েছে উপজেলা কৃষি বিভাগ। কলাকৌশল হাতে কলমে শিখাচ্ছেন তারা। ত্রিশাল উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. রুহুল আমিন জানান সেক্স ফেরোমোন ফাঁদ কিভাবে কাজ করে তা কৃষকদের শেখানো হয়েছে। একটি প্লাস্টিকের পাত্রে পানি ও ডিটার্জেন্ট পাউডার মিশিয়ে রেখে দেওয়া হয় ক্ষেতে। পাত্রের ভিতরে একধরনের ট্যাবলেট দেয়া হয় যেখান থেকে স্ত্রীপোকার গন্ধ ছড়ায়। তখন পোকারা পাত্রের ভিতরে প্রবেশ করে আর পানিতে পড়ে মারা যায়।
হলুদ কাগজের আঠালো ফাঁদ ব্যবহার নিয়ে ত্রিশাল উপসহকারি উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা এ জি এম গোলাম মোস্তফা বলেন, "এটি ক্ষেতে নির্দিষ্ট দূরত্বে টানিয়ে রাখতে হয়। কাগজে থাকা আঠার সাথে পোকা আটকে যায় আর ফসলের ক্ষতি করতে পারে না। বিষমুক্ত শবজি উৎপাদনে এটি কার্যকর একটি উপায়। আমরা কৃষি অফিস থেকে চাষীদের এসব বিনামূল্যে সরবরাহ করেছি। নেট হাউজ তৈরি করায় নতুন করে পোকা ক্ষেতে প্রবেশ করতে পারে না।"
চাষীরা বলছেন প্রথমে এসব পদ্ধতি ব্যবহারে দ্বিধাগ্রস্থ ছিলেন তারা। এখন ফলাফল দেখে আগ্রহী হচ্ছেন অন্যরাও।
কথা হয় স্থানীয় আরেক চাষী মোহাম্মদ হোসেন আলীর সাথে। তিনি জানান, "এই পদ্ধতিতে তিনি বেগুন, কপি, করলা চাষ করেছেন। আগে পোকার আক্রমণের চিন্তায় ঠিকমতো ঘুমাতে পারতাম না। এখন সকালে ঘুম থেকে উঠে ক্ষেতে গিয়ে ফাঁদে আটকাপরা পোকা ফেলি। আশপাশের কৃষকও এখন আগ্রহ দেখাচ্ছে। আমার কাছে জানতে আসে কিভাবে কেচোসার দেই আমি এবং কিভাবে পোকার আক্রমণ থেকে ক্ষেতকে রক্ষা করছি।"
উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো.হাবিবুর রহমান জানান, ত্রিশালে ২৫টি দলে ২০ জন করে কৃষক সমন্বয়ে ৫০০ জন কৃষক ১০০ একর জমিতে ব্লক আকারে জৈব কৃষি ও জৈব বালাইনাশক ব্যবহারের মাধ্যমে নানা ধরনের রবি মৌসুমের সবজি উৎপাদন করা হচ্ছে। তাদেরকে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।
এদিকে সংশ্লিষ্টরা বলছেন বিষমুক্ত নিরাপদ সবজির ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত না করলে আগ্রহ হারাবে কৃষক। তাই এখন বাজার ব্যাবস্থাপনার দিকে নজর দিতে হবে। কৃষক যেনো ফসল বিক্রি করে ভালো দাম পায়। এ বিষয়ে ত্রিশাল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শোয়েব আহমেদ বলেন, "আমরা নিরাপদ শস্য উৎপাদনে কৃষকদের আগ্রহী করতে পেরেছি। এখন চাচ্ছি ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে। আমরা সংশ্লিষ্ট অন্যান্যদের সাথে কথা বলেছি। ত্রিশাল সদরে ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে এসব নিরাপদ শস্যের একটি বাজার করার বিষয়ে কাজ করছি। সাথে সাথে যারা নিরাপদ ফসল উৎপাদন করছে তাদের সহজে চিহ্নিত করতে আইডি কার্ড দেয়ার কথা বিবেচনা করা হচ্ছে। তবে এবছর যে সাড়া পাওয়া গেছে তাতে মনে হচ্ছে আগামী বছর ভালো একটা অবস্থানে পৌঁছাবে এই বিষমুক্ত ফসল চাষ।"