টাঙ্গাইলের লক্ষাধিক তাঁত শ্রমিক কর্মহীন
''আগে প্রচুর কাজ ছিল। মাসে যা আয় হতো তা দিয়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ভালোভাবে চলতে পারতাম। পাশাপাশি আয়ের টাকা থেকে প্রতিমাসে বাবা-মাকে পাঁচ/ছয় হাজার টাকা পাঠাতাম। করোনাভাইরাসের কারণে সাড়ে তিনমাস ধরে তাঁত বন্ধ। তাই আমাদের কাজও নেই। হাতে জমানো টাকা যা ছিল তা আড়াই মাস আগেই শেষ হয়েছে। সব মিলিয়ে খুব কষ্টে দিন পার করছি।''
মঙ্গলবার দুপুরে কথাগুলো বলছিলেন টাঙ্গাইল সদর উপজেলার বাঘিল ইউনিয়নের কাঠুয়া ঝুঁগনি গ্রামের তাঁত শ্রমিক রনি মিয়া (২২)। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, সরকার ও তাঁত বোর্ড থেকে এখনো কোনো সহযোগিতা পাইনি। আয় রোজগার না থাকায় এক বেলা খেয়ে আরেক বেলা না খেয়ে দিন পার করতে হচ্ছে।
কাঠুয়া ঝুঁগনি গ্রামের লৌহজং নদীর তীরে সরকারের চার শতাংশ খাঁস জমিতে বসবাস করেন তিনি। পাশেই তাঁত মিলে গত চার বছর যাবত কাজ করেন। তাদের পরিবারে আট মাস বয়সী একটি মেয়েও আছে। দিন যতই যাচ্ছে ততই যেন তাদের কষ্টের পরিধি বাড়ছে। তাই তিনি কয়েকদিন ধরে মাটি কাটা শ্রমিকের কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন।
কিন্তু মাটি কাটার কাজ নিয়মিত না থাকায় প্রতিদিনই সেখানে গিয়ে তার কোনো লাভ হচ্ছে না। তাই কষ্টে দিন পার করতে হচ্ছে তার পরিবারের সদস্যদের।
রনি মিয়ার মতো অবস্থা একই গ্রামের নুরে আলমের। সাড়ে তিন মাস যাবত তাঁত বন্ধ থাকায় তিনিও দিন কাটাচ্ছেন খেয়ে না খেয়ে।
নুরে আলম বলেন, দুই মেয়ে এক ছেলেসহ আমার পরিবারের সদস্য পাঁচজন। সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো সহযোগিতা পাইনি। কাজ না থাকায় বাসায় বসে থেকে সময় কাটে না।
করোনাভাইরাসের কারণে রনি মিয়া ও নুরে আলমের মতো কর্মহীন হয়ে পড়া স্থানীয় মাইন উদ্দিন বলেন, আমাদের এলাকায় এক হাজার ২০০ তাঁত মেশিন রয়েছে। সেখানে ছয় শতাধিক শ্রমিক কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। কিন্তু করোনাভাইরাসে কারণে সবাই কর্মহীন হয়ে পড়েছে।
''আমি কর্মহীন। বাবা মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চলতে হয়। কিন্তু তাদের কাছেও আর টাকা চাইতে ইচ্ছে না। সব মিলিয়ে খুব কষ্টে দিন পার করতে হচ্ছে।'' বললেন মাইন উদ্দীন।
তাঁত কারখানা বন্ধ থাকায় তাদের মতো জেলার লক্ষাধিক শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছে। তাঁত বোর্ড নিয়ন্ত্রিত জেলার দুটি বেসিক সেন্টারের সূত্র মতে, জেলায় এক লাখ ২০৬ জন তাঁত শ্রমিক রয়েছেন। চার হাজার ১৫১ জন রয়েছেন ক্ষুদ্র তাঁত মালিক।
টাঙ্গাইলের তাঁত শিল্পে শ্রমিকরা আগে দিন-রাত শাড়ি উৎপাদন কাজে ব্যস্ত থাকতেন। সারাদেশের শাড়ি ক্রেতারা করটিয়া, বাজিতপুর, ও পাথরাইলের শাড়ির শোরুমগুলো থেকে শাড়ি কিনতে ভিড় জমাত।
সারা বছর ঋণের বোঝা বয়ে বেড়ানো তাঁত মালিকরা মূলত রমজান মাসেই তাদের উৎপাদিত শাড়ি বিক্রি করে ব্যাংক এনজিওর দেনা পরিশোধ করতো। কিন্ত এবার করোনায় যে সংকট তৈরি হয়েছে তাতে তাঁত মালিকরা আরও ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়ছে। বেকার হয়েছে হাজার হাজার শ্রমিক। তাঁত মালিকদের ঘরে অবিক্রিত পড়ে আছে কোটি টাকার শাড়ি।
জেলা আওয়ামী তাঁতী লীগের সভাপতি আক্কাস তালুকদার বলেন, টাঙ্গাইলের তাঁতশাড়ী আমাদের ঐতিহ্য। করোনাভাইরাসের কারণে জেলার এক লাখের অধিক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে। এতে শ্রমিকরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। সরকারের সহযোগিতা পাওয়ার জন্য ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও তাঁতবোর্ডে আবেদন করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে টাঙ্গাইল সদর উপজেলার তাঁত মালিক মমিনুর রহমান বলেন, আমার মোট ৬৩টি তাঁত রয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা শ্রমিকরা সেখানে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। করোনার কারণে এখন সব তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে।
প্রায় ৭০ লাখ টাকার শাড়ি কাপড় আটকে আছে জানিয়ে তিনি বলেন, ভরা মৌসুমে তাঁত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমাদের যে ক্ষতি হল আগামী বছরগুলোতে তার জের টানতে হবে। এ ছাড়াও দেনা শোধ করার কোনো ব্যবস্থাও নেই আমাদের। নেই সরকারের পক্ষ থেকে কোনো প্রণোদণা। তাঁত মালিক ও সাধারণ শ্রমিকদের বাঁচাতে সরকারের এগিয়ে আসা ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না।
এ ব্যাপারে তাঁত বোর্ড টাঙ্গাইল বেসিক সেন্টারের লিয়াজোঁ অফিসার রবিউল ইসলাম জানান, করোনার প্রভাবে টাঙ্গাইলের তাঁত শিল্পে প্রায় লক্ষাধিক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যে তাঁত বোর্ডের মাধ্যমে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রায় তিন হাজার দুস্থ তাঁতিদের মাঝে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
''এ মন সময়ে তাঁত মালিকদের জন্য আলাদা কোনো সরকারি প্রণোদণা না থাকলেও তাঁত মালিকদের সুবিধার্থে পাঁচ শতাংশ সার্ভিস চার্জে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। নূন্যতম ৩০ হাজার টাকা থেকে দুই লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ কার্যক্রম চালু আছে তাঁতীদের জন্য।'' যোগ করেন তিনি।
এদিকে, সর্বস্তরের তাঁত মালিক ও তাঁতিরা তাঁত শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে তৃণমুল পর্যায়ের তাঁতীদের সঙ্গে কথা বলে সব সমস্যার সমাধান করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
টাঙ্গাইল চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ড্রাটিজ এর সভাপতি খান আহমেদ শুভ জানান, টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি কুটির শিল্প। করোনাভাইরাসের কারণে টাঙ্গাইলের তাঁত মালিক ও শ্রমিকরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। তাই সরকারের সহযোগিতা তাদের খুবই প্রয়োজন।