ডেল্টা ভেরিয়েন্ট চিকিৎসকদের মৃত্যু বাড়িয়েছে
ডা শামীম আহমেদ (৫০), সহযোগী অধ্যাপক, রেজিওলজি ও ইমেজিং ডিপার্টমেন্ট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। এর আগের দিন (সোমবার) সন্ধ্যায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন টাঙ্গাইল শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অবস অ্যান্ড গাইনি ডিপার্টমেন্টের কনসালটেন্ট ডা জাকিয়া রশিদ (৪৬)। গত দুই দিনে দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন চারজন চিকিৎসক।
এনিয়ে এপর্যন্ত দেশে ১৮০ জন চিকিৎসক করোনাভাইরাসে মারা গেছেন। দেশে টিকাদান শুরুর পর অধিকাংশ চিকিৎসক টিকার আওতায় আসায় মে, জুন মাসে চিকিৎসকের মৃত্যুর সংখ্যা কম ছিল। কিন্তু, দেশে ডেল্টা ভেরিয়েন্টের সংক্রমণ বাড়ায় জুলাই থেকে চিকিৎসকের মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে।
গত সোমবার সকালে রাজধানী ঢাকার একটি হাসপাতালে মারা যান গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল ও গণস্বাস্থ্য ডায়ালাইসিস সেন্টারের চিকিৎসক নাজিব মোহাম্মদ (৬৬)।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, প্রফেসর ডা. নাজিব মোহাম্মদের মৃত্যুতে দেশের আইসিইউ চিকিৎসা সেবার অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। তিনি সৌদি আরব কিং ফয়সল মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে আইসিইউ বিভাগে দীর্ঘদিন চাকরি করেন। দেশে-বিদেশে আইসিইউ'তে উন্নত ও আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা চালুতে নাজিব অনেক অবদান রেখে গেছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারাদেশে ডেল্টা ভেরিয়েন্টের সংক্রমণ বাড়ায় চিকিৎসকদের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) দাপ্তরিক সচিব ডা. মো. শেখ শহিদুল্লাহ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড'কে বলেন, "কোভিড-১৯ সংক্রমণ বাড়ায় রোগীর সংখ্যাও বেড়েছে, ফলে চিকিৎসকদের ওপর প্রচণ্ড কাজের চাপ এসে পড়েছে। কিন্তু, সে তুলনায় সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়ানো হয়নি।"
তাছাড়া, "দেশে করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরুর দিকে চিকিৎসকদের কোয়ারেন্টিনে রাখার ব্যবস্থা ছিল। সাতদিন দায়িত্ব পালনের পর তারা ১৫ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকার সুযোগ পেতেন এবং তারপর কোভিড-১৯ প্রমাণিত হলে বাড়ি যাওয়ার সুযোগও পেতেন; এতে চিকিৎসক ও তাদের পরিবার-পরিজন সুরক্ষিত থাকতো। কিন্তু এখন তেমন ব্যবস্থা নেই। ফলে ডাক্তারদের ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেকগুণ বেড়েছে," যোগ করেন তিনি।
ডা. মো. শেখ শহিদুল্লাহ আরও চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মী নিয়োগে গুরুত্বারোপ করে বলেন, এতে করে কোভিড ওয়ার্ডে চিকিৎসকদের ওপর অতিরিক্ত কাজের চাপ কমবে এবং সংক্রমণের ঝুঁকিও হ্রাস পাবে।
দেশে করোনায় প্রথম চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছিল গত বছরের ১৫ এপ্রিল। সেদিন মারা গিয়েছিলেন সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মঈন উদ্দীন আহমদ (৪৭)।
গত বছরের জুনে প্রতিদিনই চিকিৎসকের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যানুযায়ী, ২০২০ সালের জুনে মারা গেছেন ৪৫ জন চিকিৎসক। সবচেয়ে বেশি চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে গত ৪ জুন, ওই দিন পাঁচজন চিকিৎসক মারা যান, যা এক দিনে সর্বোচ্চ সংখ্যক চিকিৎসকের মৃত্যুর ঘটনা।
গত বছরের সেপ্টেম্বরের পর থেকে চিকিৎসকদের মৃত্যুর হার কমতে শুরু করে। তবে তা এ বছরের এপ্রিলে আবার তা বেড়ে যায়। এ বছরের জানুয়ারিতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিন চিকিৎসক। ফেব্রুয়ারিতে মারা যান একজন। মার্চে মারা যান তিনজন। আর এপ্রিলে মারা গেছেন ২১ জন চিকিৎসক। মে ও জুন মাসে মারা গেছেন ৫ জন চিকিৎসক। তবে জুলাই থেকে আবার চিকিৎসকদের মৃত্যু বাড়তে শুরু করেছে। জুলাই মাসে ১৫ জন চিকিৎসক মারা গেছেন।
এব্যাপারে বিএমএ মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড'কে বলেন, ডেল্টা ভেরিয়েন্টের কারণে এখন সংক্রমিত হওয়ার দুই দিনের মধ্যেই রোগীদের লাংসে ইনফেকশন হচ্ছে এবং মৃত্যু বাড়ছে। সে কারণে অন্যান্য রোগীদের মত চিকিৎসকদের মৃত্যুও বাড়ছে। এছাড়া যেসব চিকিৎসক মারা যাচ্ছেন; তাদের মধ্যে অনেকেরই কোমর্বিডিটি (অন্যান্য রোগ) ছিল।
তিনি বলেন, এখন রোগী অনেক বেড়ে যাওয়ায় ভাইরাল লোড অনেক বেড়েছে; তাই চিকিৎসকদের এখন আরো পিপিই ব্যবহারে আরো সতর্ক হতে হবে। ভ্যাকসিন নেওয়া থাকায় ও ১৬ মাস ধরে একই কাজ করতে করতে চিকিৎসকেরা এখন পিপিই ব্যবহারে কিছুটা শিথিলতা দেখাচ্ছেন, এতে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে।
ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরীর মতে, "সংক্রমণের চক্র ভাঙ্গতে না পারলে তা বাড়বেই এবং তখন চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঝুকি আরো বাড়বে। দেড় বছরে এতো মেধাবী চিকিৎসক মারা গেলো, এ ক্ষতি অপূরনীয়। তাই সংক্রমণ রোধে-ই বেশি জোর দিতে হবে।"
বিএমএ'র ৩ আগস্টের সর্বশেষ তথ্য বলছে, সারা দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণে এপর্যন্ত ৩,০৮০ জন চিকিৎসক আক্রান্ত হয়েছেন। একই সময়ে দেশে ২,২৩৭ নার্স এবং ৩,৯৯২ জন অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।