দক্ষিণ আফ্রিকায় দাঙ্গার মধ্যে চরম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন বাংলাদেশিরা
দক্ষিণ আফ্রিকার চলমান রাজনৈতিক দাঙ্গা ও লুটপাটের কারণে চরম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন দেশটিতে বসবাসরত কয়েক হাজার বাংলাদেশি।
দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসরত বেশিরভাগ বাংলাদেশিই নিত্যপণ্যের ব্যবসা করেন। দাঙ্গা ও লুটপাটের ভয়ে গত কয়েকদিন ধরে দোকানপাট বন্ধ রেখেছেন তারা। কিছু কিছু জায়গায়, বিশেষ করে ডারবানে বাংলাদেশিদের দোকানে লুটপাটও হয়েছে।
আদালত অবমাননার অপরাধে দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমাকে ১৫ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। গত ৭ জুলাই তিনি পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করার পর থেকে দেশটিতে অস্থিরতা শুরু হয়। খবর রয়টার্সের।
জুমাকে কারাগারে পাঠানোর পর তার সমর্থকরা দেশজুড়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। তার ধারাবাহিকতায় শুরু হয় দাঙ্গা ও লুটপাট। চলমান দাঙ্গায় কমপক্ষে ৭০ জন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। ভাঙচুর চালানো হয়েছে বড় বড় অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানে। ১৯৯৪ সালে শ্বেতাঙ্গ শাসনের বিরুদ্ধে জনবিক্ষোভের পর এটিই সবচেয়ে বড় বিক্ষোভের ঘটনা।
গত বৃহস্পতিবার আরমান নামে ডারবাননিবাসী এক বাংলাদেশি অভিবাসী ফোনালাপের মাধ্যমে টিবিএসকে বলেন, 'গত পাঁচ দিন ধরে আমার দোকান বন্ধ রেখেছি, আমি আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছি। এখানকার বেশিরভাগ দোকানই বন্ধ আছে। কেউ কেউ পুলিশ প্রহরায় দোকান খোলা রাখছেন।'
তিনি আরও জানান, 'কয়েকদিন আগে আমার পাশের একটি বাংলাদেশি দোকান লুট হয়েছে। শুধু বাংলাদেশিরা নয়, এখানকার সব বিদেশি অভিবাসীই এখন চরম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।'
জোহানেসবার্গ শহরের আরেক বাংলাদেশি অভিবাসী মো. রাসেল জানিয়েছেন, পাঁচদিন বন্ধ রাখার পর অবশেষে গত বৃহস্পতিবার তিনি পুলিশ প্রহরায় দোকান খুলেছেন।
বেসরকারি হিসেব অনুযায়ী, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে প্রায় তিন লাখ বাংলাদেশি কাজ করেন। তাদের মধ্যে এক লাখেরও বেশি বাংলাদেশি থাকেন দক্ষিণ আফ্রিকায়। এ দেশে বসবাসরত সিংহভাগ বাংলাদেশিরই নিজস্ব ব্যবসা আছে।
সাধারণ সময়েও দেশটিতে প্রায় সময়ই অভিবাসীদের দোকানে ডাকাতি ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। কয়েক বছর ধরে মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলোতে মোটামুটি নিয়মিতই দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশিদের খুন হওয়ার খবর প্রচার হচ্ছে।
কেপটাউননিবাসী বাংলাদেশি ব্যবসায়ী ওমর ফারুক ফোনে টিবিএসকে বলেন, 'দক্ষিণ আফ্রিকার প্রায় সব প্রদেশেই বাংলাদেশি আছে। ডারবান আর কোয়াজুলু-নাটালে বেশিরভাগ বাংলাদেশি অভিবাসীর বাস। ওই দুই অঞ্চলে এখন সবচেয়ে বেশি অরাজকতা চলছে।'
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের (আফ্রিকা শাখা) মহাপরিচালক মো. তরিকুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের দক্ষিণ আফ্রিকা দূতাবাস থেকে নিয়মিত রিপোর্ট পাচ্ছি। কিছু লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। তবে কোনো বাংলাদেশি আহত বা নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।'
তিনি আরও বলেন, 'দক্ষিণ আফ্রিকার বর্তমান পরিস্থিতি আমরা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। চলমান দাঙ্গা ও লুটপাটে বাংলাদেশিদের বিশেষভাবে টার্গেট করা হয়নি। আমাদের দূতাবাস স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে সর্বক্ষণ যোগাযোগ রাখছে।'
মো. তারিকুল ইসলাম বলেন, ধীরে ধীরে, বিশেষ করে গত দুই দিন ধরে দক্ষিণ আফ্রিকার পরিস্থিতি ভালো হচ্ছে।
অস্থিরতায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসা
সাবেক প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমাকে কারাগারে পাঠানোর ফলে যে বিক্ষোভের শুরু, দারিদ্র্য ও বৈষম্যের কারণে তা চরম আকার ধারণ করেছে।
পুলিশ জানিয়েছে, বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কিছু অপরাধী চুরি ও ভাঙচুর চালাচ্ছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার বহু ক্ষুদ্র, মাঝারি ও অতিক্ষুদ্র শিল্প উদ্যোগের বীমা করানো নেই। এর ফলে অস্থিরতার কারণে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা কাটিয়ে ওঠা আরও কঠিন হবে।
জোহানেসবার্গের গাড়ি ব্যবসায়ী ওকে উচেন্দু। তার অধীনে ১৬ জন কর্মচারী কর্মরত আছেন। উচেন্দু জানিয়েছেন, 'আমরা ছোট ব্যবসা চালাই। এখানে, জুলস স্ট্রিটে কেউই বীমা করতে চায় না। এটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। বীমা করানোর জন্য ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে ফোন করলে ওরা মানা করে দেয়। কারণ আমাদের এই এলাকা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।'
গত বছর স্মল বিজনেস ইনস্টিটিউট (এসবিআই) তাদের চালানো এক জরিপের ফল প্রকাশ করে। ওই জরিপ অনুসারে, দক্ষিণ আফ্রিকার ৫৫ হাজার ক্ষুদ্র, মাঝারি ও অতিক্ষুদ্র শিল্প উদ্যোগ সম্ভবত করোনা মহামারিতে টিকে থাকতে পারবে না। তার ওপর সাম্প্রতিকতম দাঙ্গার কারণে এই সংখ্যা আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এসবিআইয়ের প্রধান নির্বাহী জন লুদ্লু রয়টার্সকে এ তথ্য জানান।
গত বুধবার দক্ষিণ আফ্রিকান প্রপার্টি ওউনার্স অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত দেশটিতে ২০০-র বেশি মল লুট বা ধ্বংস হয়েছে। ৬০০টির বেশি দোকান পুড়ে গেছে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
কোয়াজুলু-নাটাল ও গাউটেং প্রদেশে দুই শতাধিক মদের দোকান লুট করা হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
খুচরা পোশাক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান মিস্টার প্রাইসের (এমআরপিজে.জে) মতো বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যাপক লুটপাট চালানোর পর কয়েক'শ দোকান সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিছু মলও বন্ধ হয়ে গেছে লুটপাটের কারণে।