দুই সপ্তাহে দেশে করোনায় প্রাণ হারাল ৭১৫ জন
দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের সেকেন্ড ওয়েভে মৃত্যু অনেকে বেড়েছে। এখন সংক্রমণের ৫৭ তম সপ্তাহ চলছে। এই সপ্তাহের ছয়দিনে (৪-৯ এপ্রিল) করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে মারা গেছেন ৩৭১ জন। এক সপ্তাহে এত মৃত্যু গত ১৩ মাসে আর কখনোই হয়নি। বৃহস্পতিবার একদিনে মারা গেছেন ৭৩ জন, যা এখন পর্যন্ত একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণ বাড়লে মৃত্যুও বাড়বে। মৃত্যু কমাতে হলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু এরইমধ্যে দেশের হাসপাতালগুলোর সক্ষমতা ছাড়িয়ে গেছে। একটি সাধারণ বেড বা আইসিইউয়ের জন্য রোগীদের ভোগান্তি তীব্র হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, করোনা সংক্রমণের প্রথম ওয়েভে বছরের ৫-১১ জুলাই (সংক্রমণের ১৮ তম সপ্তাহ) মৃত্যুর সংখ্যা বেশি ছিল। সে সময় এক সপ্তাহে মারা গেছেন ৩০৮ জন। এরপর গত সপ্তাহে (২৮ মার্চ থেকে ৩ এপ্রিল) মারা গেছেন ৩৪৪ জন।
চিকিৎসকেরা বলছেন, শিগগিরই মৃত্যু কমে আসার কোন সম্ভাবনা নেই। এখন যারা মারা যাচ্ছেন তারা করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছিলেন আরো কয়েক সপ্তাহ আগে। এখন প্রতিদিন ৭ হাজারের বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, তাই আগামী দুই-তিন সপ্তাহ পর মৃত্যু আরও বাড়ার ঝুঁকি রয়েছে।
মারাত্মক সংক্রামক এই ভাইরাসটি গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত হয়েছে দেশের আরও ৭ হাজার ৪৬২ জনের দেহে। মহামারি শুরুর পর থেকে সব মিলিয়ে এই শনাক্তের সংখ্যা পৌঁছেছে ৬ লাখ ৭৩ হাজার ৬৯৪ জনে।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত একদিনে বাংলাদেশে আরও ৬৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত এক বছরেরও বেশি সময়জুড়ে প্রাণঘাতি এই ভাইরাসটি কেড়ে নিয়েছে ৯ হাজার ৫৮৪ জনের জীবন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, করোনায় পুরুষের মৃত্যু বেশি হচ্ছে। দেশে করোনায় মৃতদের মধ্যে পুরুষ ৭৪.৮৪% ও নারী ২৫.১৬%। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হচ্ছে ৬০ বা তার বেশি বয়সী মানুষের। আর করোনায় যাদের মৃত্যু হচ্ছে, তাদের ৫৮% ঢাকা বিভাগে। তবে সেকেন্ড ওয়েভে অল্প বয়সীরাও মারা যাচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় মৃতদের মধ্যে ২১ থেকে ৪০ বছর বয়সীদের মধ্যে সাতজন মারা গেছেন।
৫০০ শয্যাবিশিষ্ট কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের অ্যানাস্থেসিওলজিস্ট ডা. নাজনীন রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, অনেক তরুণ রোগী এখন আইসিইউতে ভর্তি হয়েছেন।
তিনি বলেন, "আমরা আইসিইউতে ৩০ বছরের কম বয়সী রোগীও পেয়েছি। এখন ৩০-৪০ বছর বয়সী অনেক রোগী পাওয়া যাচ্ছে।"
ইদানীং রোগীর অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটছে
গত বুধবার বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র (আইসিডিডিআরবি) জানায়, দেশে করোনার দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট থেকে কোভিড -১৯ রোগীর সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আইসিডিডিআরবি বলে, "বাংলাদেশে মার্চের চতুর্থ সপ্তাহে দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টটি ৮১% সংক্রমণ দখল করে ছিল"।
দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টটি অন্যান্য ভ্যারিয়েন্ট থেকে ৭০% বেশি মারাত্মক।
দক্ষিণ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টের পাশাপাশি দেশে ইউকে ভ্যারিয়েন্টও পাওয়া গেছে। নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্টের কারণে এবার রোগীদের দ্রুত অবস্থার অবনতি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। এছাড়া এবার একই পরিবারে কয়েকজন করে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে।
ঢাকার মুগদা জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউয়ের অ্যানাস্থেসিওলজিস্ট ডা. অনিরুদ্ধ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'এবারের ওয়েভে দ্রুত রোগীদের অবস্থার অবনতি হচ্ছে। আগে লক্ষণ দেখা দেয়ার পর ৮ থেকে ১০ দিন পর রোগীর অবস্থার অবনতি হত। কিন্তু ইদানীং দুই একদিনের মধ্যেই রোগীর অবস্থার অবনতি হয় এবং একই অবস্থায় অনেকদিন থাকে। এখন বেশিরভাগ রোগীর অক্সিজেন প্রয়োজন হচ্ছে। এছাড়া এখন অনেক রোগীর হিমোগ্লোবিন কমে যাচ্ছে, যা একেবারে নতুন'।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান বলেন, 'আক্রান্ত বাড়লে মৃত্যুও বাড়বে। আমাদের মৃত্যুহার কিন্তু কম। তবে এখন হাসপাতালগুলোর ধারণ ক্ষমতা ছাড়িয়ে যাওয়ার কারণে চিকিৎসার অভাবে মৃত্যু বাড়বে। এখন এমন কিছু মৃত্য হবে যা হওয়ার ছিল না। সংক্রমণ কমাতে, হাসপাতালের ওপর চাপ কমাতে ও মৃত্যু কমাতেই মূলত লকডাউন দিতে হয়। এছাড়া মানুষকে সেবা দিতে বড় শহরগুলোতে জরুরি ভিত্তিতে স্বাস্থ্য অবকাঠামোর সম্প্রসারণ প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে প্রয়োজনে সেনাবাহিনী বা অন্য বাহিনীর যে স্বাস্থ্য সুবিধা আছে সেগুলোকে ফিল্ড হাসপাতাল আকারে স্থাপন করতে হবে'।