দুর্দিনে পাবনার কাঁচি শিল্প
নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মধ্যে মানুষের বহুল ব্যবহৃত একটি সামগ্রী হলো কাঁচি। এমন কোনো পরিবার নেই যেখানে কাঁচির ব্যবহার দেখা যায় না। কিন্তু, প্রয়োজনীয় এই জিনিস যারা তৈরি করে থাকেন তাদের দিন আর ভালো কাটছে না। কাঁচি তৈরির প্রতিষ্ঠানগুলোর চলছে ঘোর দুর্দিন।
কাঁচি তৈরির জন্য বাংলাদেশের পাবনা জেলা বিখ্যাত। খুব বেশি দিন আগের কথাও নয়, ১৯১০ সালে পাবনায় ব্যাপকভাবে কাঁচি তৈরি শুরু হয়। তার আগেও এ জেলাতে কাঁচি শিল্প কারখানা ছিল, তবে তা হাতে গোনার মত। জনসংখ্যা বিবেচনায় তখন যে কাঁচি তৈরি হতো তা দিয়ে পুরো ভারতবর্ষের চাহিদা পূরণ হতো।
পাবনার কাঁচির গুণগত মান ভালো হওয়ায় দিনদিন তার চাহিদা বাড়তে থাকে। ভারতবর্ষ ছাড়াও অন্যান্য দেশে যেতে থাকে পাবনার কাঁচি। চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় শিল্পগুলো যখন কাঁচির যোগান দিতে হিমশিম খেতে থাকে, তখন এ শিল্পে যোগ দিতে থাকে নতুন নতুন শিল্প উদ্যোক্তা।
লাভ ভালো হওয়ায় অনেকেই শহর ও শহরতলীতে নিজস্ব জমি কিনে স্থায়ীভাবে শিল্প গড়ে তোলে। তখন কাঁচি তৈরির উপকরণ ও কাঁচামাল সহজলভ্য হওয়ায় এই শিল্প ব্যাপক প্রসার লাভ করে।
কৃষি কাজের তুলনায় কাঁচি শিল্পের শ্রমিকেরা মজুরি বেশি পাওয়ায় এ পেশাতে কাজ করার জন্য শ্রমিকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। শ্রমিক ও কাঁচামালের সংকট না থাকায় পাকিস্তান সরকারের আমল পর্যন্ত দুই সহস্রাধিক শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে পাবনায়।
তদানীন্তন সরকার পাবনার উৎপাদিত কাঁচি চায়নাসহ বর্হিবিশ্বে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে শুরু করে। এ সময় কাঁচি শিল্পে পাবনাতে প্রায় কুড়ি হাজার শ্রমিক কাজ করত।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বেশ কিছু শিল্প হানাদার বাহিনী দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চুরি অথবা লুট হয়ে যায় শিল্পের যন্ত্রপাতি। এ অবস্থায় যুদ্ধ বিধ্বস্ত পাবনায় মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পের মালিকরা আর পুঁজি বিনিয়োগ করতে সমর্থ হয়নি। ফলে, কাঁচি শিল্পের ধ্বস নামতে থাকে পাবনায়।
ধীরে ধীরে কাঁচি শিল্পের দুর্দিন শুরু হতে থাকে। পাবনার ঐতিহ্যবাহী সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর সংখ্যাও মাত্র পাঁচশতে নেমে আসে।
কাঁচি শিল্পের সঙ্গে জড়িত মো. আব্দুল্লাহ জানান, "কাঁচি সাধরণত দুই ভাবে তৈরি করা হয়। একটি লোহা দিয়ে, অপরটি বিভিন্ন কাঁচামালের সাহায্যে ফরমা তৈরি করার মাধ্যমে। এদের দামও ভিন্ন হয়ে থাকে। তবে লোহা ভাল হলে লোহার কাঁচির দাম বেশি হয়। এর চাহিদাও বেশি।"
কাঁচামালে তৈরিকৃত কাঁচি বাসাবাড়ি ও ছোটখাটো দর্জি দোকানে বিক্রি হয়ে থাকে। এর দাম লোহার কাঁচির চেয়ে কিছুটা কম। এ শিল্পে কাঁচি তৈরি করতে কয়েকটি ধাপ রয়েছে। এক একটি ধাপে ভিন্ন ভিন্ন শ্রমিক কাজ করে। মজুরিও ভিন্ন ভিন্ন।
লোহার কাঁচি লোহাকে আগুনে পুড়িয়ে পিটিয়ে সাইজ মতো কেটে ছেড়ে দেওয়া হয়। অন্যস্থানে আবার পিটিয়ে তার আঙ্গুলি তৈরি করা হয়। এ্ররপর নাটবোল্ট সেট করার জন্য ছিদ্র করা হয়। পরে শানে দিয়ে ধার করে নাটবোল্ট লাগালেই বাজারজাত করার জন্য কাঁচি প্রস্তুত হয়।
পাবনায় এ শিল্প প্রতিষ্ঠান কমে যাওয়ায় বাজারজাতের কোনো সমস্যা হয় না। ঢাকার বড় বড় পাইকারী প্রতিষ্ঠান অগ্রীম অর্ডার দিয়ে থাকে। আকার ভেদে এর দামও ভিন্ন। আট ইঞ্চি, দশ ইঞ্চি, বা্রো ইঞ্চি প্রভৃতি বিভিন্ন সাইজের কাঁচি তৈরি করা হয়।
গার্মেন্টস, দর্জি দোকান ছাড়াও বাসায় ব্যবহারের জন্য মানুষ এই কাঁচি কিনে থাকে। প্রকারভেদে বর্তমানে প্রতিটি কাঁচি বাজারে বিক্রি হয় ২০০ টাকা থেকে এক হাজার ৫০০ টাকায়।
লোহার তৈরি কাঁচি ছাড়াও পাহাড়ের বিশেষ ধরনের গুঁড়া করা হলুদ মাটি, পাহাড়ি হলুদ বালি, লোহার গুঁড়া, থাই অ্যালুমিনিয়ামের গুঁড়া, ভাটি, রাফ বালু ও চিটা গুড় মিশিয়ে এক ধরনের ক্যামিকেল তৈরি করে সেটা ছাঁচে ঢেলে আগুনে পুড়িয়ে কাচি তৈরী করা হয়ে থাকে।
এ ধরনের একেকটি প্রতিষ্ঠান প্রতিদিন একশ'টি করে কাঁচি তৈরি করতে পারে। এই কাঁচামালগুলো অনেক সময় দুষ্প্র্রাপ্য হয়ে পড়ে। এ ধরনের কারখানাতে প্রায় পাঁচ লক্ষ টাকা পুঁজি বিনিয়োগ করতে হয়।
বাজারে এ জাতীয় কাঁচির দাম কম হলেও লোহার কাঁচির মত এতে মরিচা ধরে না। এই কাঁচির উৎপাদন খরচ ১২০ টাকা থেকে ১৪০ টাকা পড়লেও বাজারে প্রায় ২০০ টাকা দরে খুচরা বিক্রি হচ্ছে।
পাবনার শালগাড়িয়া গ্রামের কাঁচি শিল্পের মালিক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, "বাপদাদার ব্যবসা হিসাবে এ প্রতিষ্ঠান ধরে রেখেছি। লোহা শান ও অন্যান্য মালের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় খুব একটা লাভের মুখ দেখা যাচ্ছে না এ শিল্পে।"
"আগে এ শিল্পে বেশ লাভবান হয়েছে ব্যবসায়ীরা। বর্তমানে বাজার জাতেরও সমস্যা হচ্ছে। পাবনার কাঁচি এক সময় চীনে রপ্তানি করা হতো। এখন সেই চীন থেকে এ দেশে কাঁচি আমদানি করা হচ্ছে," বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, "গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র। কিন্তু বড় বড় গার্মেন্টস শিল্পে বর্তমানে মেশিনের সাহায্যে কাপড় কাটা হচ্ছে। মাঝারি ও ক্ষুদ্র গার্মেন্টস শিল্পগুলোতে ব্যবহার করা হচ্ছে চায়না ও পাকিস্তানি কাঁচি। সেখানে পাবনার কাঁচির অবস্থান নিচে নেমে এসেছে।"
তবে ঢাকা ও চট্টগ্রামের কিছু পাইকারি প্রতিষ্ঠান আছে, যারা পাবনার তৈরী কিছু সংখ্যক কাঁচি মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডসহ কয়েকটি দেশে রপ্তানি করতে সমর্থ হয়েছে বলেও জানান তিনি। এটা ব্যাপক আকারে করতে পারলে এ শিল্পটি পূর্বের ন্যায় আলোক মুখ দেখতে পারবে।
অপর ব্যবসায়ী উজ্জল হোসেন জানান, "সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় শিল্পটির দুর্দিন চলছে। সরকা্রি পৃষ্ঠপোষকতা ও সহজ শর্তে ঋণ পেলে শিল্পটিকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে। বর্তমানে শ্রমিক সংকটও একটি বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে এ শিল্পে। অভিজ্ঞ শ্রমিক ছাড়া এ শিল্প পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়েছে।"
কাঁচি শিল্পের সাথে জড়িত শ্রমিক ফজল শাহীন জানান, "এ শিল্পে বর্তমানে যে মজুরী পাওয়া যাচ্ছে, তা দিয়ে পরিবার পরিজনসহ জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এ শিল্পে কোনো বেতন নেই। রেট পদ্ধতিতে কাজ করতে হয়। কাজ আছে হিসাবমত টাকা আছে, কাজ নাই টাকাও নাই"।
তিনি আরও বলেন, "একজন শ্রমিক অসুখে পড়লে তার বাড়ির সবাইকে উপোস থাকতে হয়। প্রতিটি কাঁচি শান করে পাওয়া যায় ১৮ টাকা। আট ঘণ্টা কাজ করে ২০টির বেশি কাঁচি শান করা সম্ভব হয় না। অন্যদিকে, শানের কুচি গুঁড়া অনেক সময় চোখে গিয়ে অন্ধও হতে হয়"।
"ছোট থেকে বাপদাদার হাত ধরে এ পেশা বেছে নিয়ে এখন অন্য পেশাতেও যেতে পারছি না। জীবিকার তাগিদে বর্তমানে বাধ্য হয়ে প্রায় তিন হাজার শ্রমিক এই খাতে কাজ করছে," জানান তিনি।