দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ২০২৩ সাল থেকে আসছে বড় পরিবর্তন
প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত দেশের শিক্ষাক্রমে আগামী ২০২৩ সাল থেকে বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসছে সরকার। আর ২০২৫ সাল থেকে শুরু হবে পুরোপুরি নতুন শিক্ষাক্রম।
নতুন শিক্ষাক্রমের আওতায় ২০২৩ সাল থেকে প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নতুন পাঠ্যসূচির আলোকে বই পাবে। তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নতুন বই পাবে ২০২৪ সাল থেকে। আর পঞ্চম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা পাবে ২০২৫ সাল থেকে।
একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ২০২৬ সালে ও দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ২০২৭ সালে নতুন পাঠ্যসূচির আওতায় বই দেবে সরকার।
অর্থাৎ নতুন পাঠ্যক্রমের আওতায় ২০২৬ সালে শিক্ষার্থীরা এসএসসি এবং ২০২৮ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নেবে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা বিষয়ে সোমবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি।
তিনি বলেন, এই সময়ের মধ্যে নতুন শিক্ষাক্রমের জন্য প্রস্তুতি সম্পন্ন করবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
নতুন এই শিক্ষাক্রমে আগের মতো নবম ও দশম শ্রেণিতে থাকবে না বিভাগভিত্তিক বিভাজন। অর্থাৎ বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও মানবিক বিভাগের যে ধারণা সেটি নবম শ্রেণিতে শুরু না হয়ে একাদশ শ্রেণিতে শুরু হবে।
এছাড়াও নতুন এই শিক্ষাক্রমে থাকবে না পিইসি ও জেএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষাগুলো। এমনকি তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো ধরনের বার্ষিক পরীক্ষাও নেওয়া হবে না নতুন এই শিক্ষাক্রমে।
২০২৩ সাল থেকে শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষাজীবনের প্রথম পাবলিক পরীক্ষা শুরু করবে এসএসসি'র মাধ্যমে। এছাড়া উচ্চ মাধ্যমিক অর্থাৎ এইচএসসি পরীক্ষা হবে দুই ধাপে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির ফলাফলের ভিত্তিতে তৈরি করা হবে এইচএসসি'র ফলাফল।
সোমবার গণভবনে 'জাতীয় শিক্ষা কাঠামোর' খসড়া রূপরেখার একটি উপস্থাপনা দেখার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, 'সরকারের নীতি অনুসরণ করে শিক্ষার কাঠামোকে আধুনিকায়ন করা হচ্ছে। বাংলাদেশকে বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিশ্ব যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে বাংলাদেশকে পিছিয়ে থাকলে হবে না। বিশ্ব ও প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশকে অবশ্যই এগিয়ে যেতে হবে। শিক্ষার কাঠামো সময় উপযোগী হওয়া দরকার।'
তিনি আরও বলেন, "শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষা কার্যক্রমকে আরও আকর্ষণীয় করার পাশাপাশি তাদের জীবন ও জীবিকা সম্পর্কিত পাঠ শেখানোর জন্য সেখানে ব্যবস্থা তুলে ধরা হয়েছে।"
নতুন পাঠ্যসূচিতে তাত্ত্বিক জ্ঞানের পরিবর্তে শিক্ষার্থীদের পারদর্শিতার উপর জোর দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি।
এরমধ্যে রয়েছে শিক্ষার্থীদের যোগাযোগ করার সামর্থ্য, সমন্বয়, নিজেদের প্রকাশ করা, অন্যদের মতামতকে শ্রদ্ধা করা, গভীরভাবে চিন্তা করা, সমস্যার সমাধান করা, ভাষা শিক্ষা, যোগাযোগ, গণিত, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, আইসিটি, পরিবেশ ও জলবায়ু এবং মূল্যবোধ ও নৈতিকতা।
নতুন শিক্ষা কাঠামো অনুসরণ করে পাঠ্যক্রমের বিষয়বস্তু তৈরি করা হবে। ২০২২ সাল জুড়ে শিক্ষকদের দেওয়া হবে প্রশিক্ষণ।
যেভাবে হবে মূল্যায়ন
প্রথম শ্রেণি থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা ক্লাসে পারফরম্যান্স বা শিখনকালীন মূল্যায়ন এর ভিত্তিতে ফলাফল পাবে।
চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞানে ৬০ শতাংশ ক্লাস পারফর্মেন্স এবং ৪০ শতাংশ সামষ্টিক মূল্যায়ন করা হবে। এছাড়া শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, ধর্ম শিক্ষা এবং শিল্পকলা বিষয়ে ক্লাস পারফর্মেন্স দিয়ে শতভাগ মূল্যায়ন করা হবে।
ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞানে ক্লাস পারফর্মেন্স ৬০ শতাংশ এবং সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে ৪০ শতাংশ। এছাড়া জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, ধর্ম শিক্ষা এবং শিল্প ও সংষ্কৃতি বিষয়ে শিখনকালীন শতভাগ মূল্যায়ন করা হবে।
নবম ও দশম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞানে ৫০ শতাংশ ক্লাস পারফর্মেন্স এবং বাকি ৫০ শতাংশ সামষ্টিক মূল্যায়ন করা হবে। এছাড়া জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, ধর্ম শিক্ষা এবং শিল্প ও সংষ্কৃতি বিষয়ে শতভাগ ক্লাস পারফর্মেন্স এর ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হবে। দশম শ্রেণি শেষে দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির উপর পাবলিক পরীক্ষা হবে।
একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে আবশ্যিক বিষয়ে ক্লাস পারফর্মেন্স ৩০ শতাংশ এবং পাবলিক পরীক্ষার মাধ্যমে সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে ৭০ শতাংশ।
নতুন এ শিক্ষাক্রম অনুযায়ী, ২০২২ সাল থেকে দেশের ১০০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষামূলকভাবে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে এই পাঠ্যক্রম চালু করা হবে। ২০২৩ সাল থেকে নতুন পাঠ্যক্রমের অধীনে এই দুই শ্রেণির শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবই পাবে।
প্রাথমিকের ক্ষেত্রে দেশের ১০০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ পাঠ্যক্রম চালু করা হবে ২০২২ থেকে। আর সারাদেশের শিক্ষার্থীরা এই পাঠ্যক্রমের বই পাবে ২০২৩ সাল থেকে।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. সিদ্দিকুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, অনেক বছর ধরেই তারা পিইসি এবং জেএসসি পরীক্ষাগুলো বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছিলেন।
"আমি খুবই খুশি হলাম এটা জেনে যে, সরকার এই ধরনের পাবলিক পরীক্ষাগুলো বাতিলের উদ্যোগ নিয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "এটা খুবই ভালো পদক্ষেপ যে সরকার ভবিষ্যতে দক্ষ প্রজন্ম গড়ে তোলার জন্য পাঠ্যসূচিতে রদবদল আনছে। আমার চাওয়া হল- সরকারকে অবশ্যই প্রকৃত বিশেষজ্ঞদের সাহায্যে নতুন পাঠ্যক্রমের খসড়া তৈরি করতে হবে। দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে এই পাঠ্যক্রমের খসড়া তৈরি হওয়া উচিত।"
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "মন্ত্রণালয় ধাপে ধাপে পাঠ্যক্রম বাস্তবায়ন করবে। আমি মনে করি নতুন কারিকুলামটি দেশে অত্যন্ত কার্যকরী হবে।"