ধান চাষে স্থানীয় জাতের ব্যবহারে জায়গা নিয়েছে ‘উফশী’
এক দশক আগেও ধানের বীজ হিসেবে কৃষককে নির্ভর করতে হতো স্থানীয় জাতের ওপরই। তবে এ নির্ভরতা এখন প্রায় শূণ্যের কোঠায়। এই জায়গায় দখল করে নিয়েছে উচ্চ ফলনশীল (উফশী) ও হাইব্রিড জাতের বীজ।
কৃষি মন্ত্রণালয়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই), বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি), বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিআরআরআই) সূত্রে জানা গেছে, উন্নতমানের বীজ, তিন-চারগুণ বেশি ফলন পাওয়া যাচ্ছে বলে কৃষকরা ধানের এসব বীজ ব্যবহার করছে। অন্যদিকে স্থানীয় জাতের চাষাবাদ নেমে এসেছে তলানীতে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে আউশ, আমন ও বোরো মৌসুমে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়েছে উফশী জাতের বীজ। তিনটি মৌসুমে সর্বমোট ১,৪২,২৮৩ মেট্রিক টন উফশী জাতের বীজ ব্যবহার করেছে সারাদেশের কৃষকরা। ১৫,৭৭৭ টন হাইব্রিড বীজ ব্যবহার হয়েছে। যেখানে স্থানীয় জাত মাত্র ২৬০ টন। কৃষক ধানের ফলন পেয়ে সেখান থেকে বীজ হিসেবে যেটা রাখে এবং পরবর্তী মৌসুমে চারা তৈরির জন্য ব্যবহার করে সেটাই স্থানীয় জাত। একসময় ধানের বীজই পুরোটাই স্থানীয় জাতের উপর নির্ভরশীল ছিল।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে ব্রি উদ্ভাবিত জাতের সংখ্যা মোট ১০৬টি। এর মধ্যে ৭টি হাইব্রিড। বাকিগুলো সহই উফশী। তবে এর মধ্যে কিছু উচ্চফলনশীল জাত শুরু নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলের জন্য।
জানা গেছে, উফশীর ব্যবহার অল্প পরিসরে শুরু হয়েছে ষাটের দশকে। তখন এটি ছিল আমদানি নির্ভর। তবে এর ব্যবহার ব্যপকভাবে বেড়েছে সর্বশেষ ৫-৬ বছরের মধ্যে।
গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার কৃষক সিরাজউদ্দিন তালুকদার বলেন তার বাবার মুখে শোনা গল্পের উদ্বৃতি দিয়ে বলেন, 'আমরা বাবা ১৯৬৯ সালে মাত্র ১ বিঘা জমিতে উফশী জাতের ইরি-৮ নামের ধান চাষ করে। কিন্তু অধিকাংশ জমিতে তখনো স্থানীয় জাতের চাষ হতো।'
তিনি বলেন, স্থানীয় জাতের তুলনায় উফশীতে অন্তত ৪-৫ গুণ বেশি ফলন পাওয়া যায়। যে কারণে আমরা এখন বেশিরভাগই উফশীর আবাদ করছি।
ডিএই বলছে, চলতি বোরো মৌসুমে সারাদেশে সবচেয়ে বেশি আবাদ হচ্ছে ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯ জাতের ধান। দুটি জাতের চালই মাঝারি চিকন ও সাদা দেখতে। ব্রি'র তথ্যমতে ব্রি-২৮ এর হেক্টরপ্রতি ফলন সাড়ে পাচ থেকে ৬ টন। ব্রি-২৯ এর হেক্টরপ্রতি ফলন ৭ টনের বেশি। এছাড়া ব্রি-৫৮, ব্রি-৫০ ও ব্রি-৬৭ সারাদেশে বেশ চাষ হচ্ছে।
ব্রি'র মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, উফশীর চাষই এখন বেশি হচ্ছে। আর এই জাতগুলো আমাদেরই উদ্ভাবন। সারাবছর ব্যবহৃত ধানের বীজের ৮০ শতাংশই ব্রী'র উদ্ভাবিত। কয়েকগুন বেশি ফলন হওয়ার কৃষকরা এই জাতগুলো বেশি ব্যবহার করছে।
তিনি বলেন, হাইব্রিড ছাড়া এখন উফশী জাতের ধানের বীজ দেশেই উৎপাদন হচ্ছে।
ভারত, চীন সহ কয়েকটি দেশ থেকে হাইব্রিড ধানের বীজ আমদানি হয়। তবে উফশী জাতের বীজ সরকার ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সরবরাহ করছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে আউশে যে পরিমাণ উফশী জাত ব্যবহার হয়েছে তার মধ্যে ১৭ শতাংশ এবং হাইব্রিডের শতভাগই সবরাহ করেছে বেসরকারী বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। এছাড়া আমনে ২৬.২৮ শতাংশ উফশী ও ৯৯ শতাংশ হাইব্রিড এবং বোরোতে ৮২.৯৬ শতাংশ উফশী ও শতভাগ হাইব্রিড বীজ বেসরকারী প্রতিষ্ঠান সরবরাহ করেছে।
লাল তীর সীড লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার ড. এম এ রশীদ টিবিএসকে বলেন, 'বীজ সরবরাহে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও পিছিয়ে নেই। কারণ এখন কৃষকের মধ্যে উফশী বীজ ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। হাইব্রিডের ব্যবহারও ধীরে ধীরে বাড়ছে।'
হাইব্রিড বীজের উৎপাদনে সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও গুরুত্ব দিয়ে গবেষণা করছে বলে জানান তিনি।
সামগ্রিক বিষয়ে ডিএই এর মহাপরিচালক মো. আসাদুল্লাহ টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের জমির পরিমাণ কমলেও প্রতিনিয়তই উৎপাদন বাড়াতে গুরুত্ব দিতে হচ্ছে। কারণ খাওয়ার মানুষ বাড়ছে। এ কারণে উচ্চফলনশীল জাতের বিকল্প নেই।'
তিনি বলেন, 'আমরা চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পেরেছি উচ্চফলনশীল জাতগুলোর ব্যপক ব্যবহারের কারণে। প্রতিনিয়তই গবেষণা চলছে উচ্চফলনশীল জাতের উদ্ভাবন ও ব্যবহার বাড়ানোর জন্য।'