লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালীতে বন্যার পর লাগানো বীজে ধান নেই; কাঁচা ধানের গাছ কেটে ফেলছেন কৃষকরা
জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়। অতীতে এ সময়ে ক্ষেতে আমন ফসল থাকতে দেখা না গেলেও চলতি জানুয়ারির ১৫ তারিখের পরেও শতশত একর জমিতে আমন ধানের গাছ রয়েছে; একেবারে সবুজ কাঁচা ধান। যেগুলো পাকতে আরও কমপক্ষে ১৫-২০ দিন সময় লাগার কথা। তবে বেশির ভাগ ক্ষেতে শুধু গাছই আছে, ধান নেই। ধানের শীষ বের হচ্ছে না অথবা বের হলেও ধান ছিটা।
লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী জেলার অনেকগুলো এলাকার মাঠজুড়ে দেখা গেছে এমন করুণ দৃশ্য।
ধানের এমন করুণ অবস্থায় কৃষকদের মাঝে চরম হতাশা বিরাজ করছে। কৃষকরা বাধ্য হয়ে কাঁচা সবুজ ধান গাছ কেটে গরুর ঘাস হিসেবে ব্যবহার করছেন। ক্ষেতের আইলে বসে এমনটাই জানালেন, কৃষক আনোয়ার (৬০) এবং মতিউর (৫৫)।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার তেওয়ারিগঞ্জ ইউনিয়ন এবং নোয়াখালীর সদর উপজেলার সীমান্তবর্তী মাইজচরা গ্রাম। এ গ্রামের কৃষক আনোয়ার। তিনি জানালেন, বন্যার কারণে পর পর পাঁচবার বীজ লাগিয়েও চারাগাছ নষ্ট হয়ে গেছে। ৬ষ্ঠ বার বাজার থেকে ধানের চারা কিনে জমিতে লাগিয়েছিলেন তিনি। মনে মনে ভাবছিলেন, হয়তো ভালো ফলন পাবেন। অক্টোবরেই জমি শুকিয়ে গিয়েছিল। ধানে কয়েক বার সেচও দিয়েছেন কৃষক। কিন্ত জানুয়ারির ১৫ তারিখেও গাছ থেকে শীষ বের হচ্ছে না বলে আক্ষেপ করলেন। ধান পাবেন বলে আর আশাও করতে পারছেন না। তাই এখন সবুজ ধান গাছ কেটে ফেলছেন।
কৃষক আনোয়ার আরও জানান, "৪০ শতক জমিতে সব মিলে আমার প্রায় ১৫ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। হাতে কোনো কাজও নেই। তাই এখন চরম দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে।"
কমলনগরের চর কাদিরা গ্রামের কৃষক মতিউর ও কামাল । পাশাপাশি জমিতে তারা ৪ বারের পর পঞ্চমবার বীজ লাগিয়েছেন। কিন্ত তাদের সে কষ্টের ধানেও কোনো ফলন নেই। তারা দুজনই ঘাস হিসেবে সবুজ গাছ কেটে গরুকে খাইয়ে ফেলছেন।
মাঠঘুরে দেখা গেছে– নোয়াখালী সদর, লক্ষ্মীপুর সদর, কমলনগর এবং রামগতি উপজেলার শতশত একর জমিতে এখন এমন অবস্থা রয়েছে। এতে হতাশ হয়ে পড়েছেন কৃষকরা। অনেক কৃষক সবুজ ধান গরুর ঘাস হিসেবে বিক্রি করে ফেলছেন। অনেকে ধান গাছ কেটে নতুন করে সয়াবিন চাষের জন্য জমি প্রস্তুত করছেন।
স্থানীয় ভাবে জানা, গেছে ২০২৪ সালের আগস্টের ভয়াবহ বন্যায় নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর জেলার মধ্যে যেসব এলাকা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেগুলোর মধ্যে গ্রামের প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ কৃষক ও শ্রমিক। আয়ের আর বিকল্প উপায় না থাকায় তারা সবাই চাষাবাদ করেন।
বন্যার পর বীজ না থাকা সত্ত্বেও তারা দূরদুরান্ত থেকে বীজ সংগ্রহ করেছিলেন ফলনের আশায়। তবে ফলন না পেয়ে আবারও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন তারা।
কিন্তু এবার ধান নিয়ে কৃষকদের এমন অবস্থা কেন হলো? — বিষয়টি জানতে চাইলে চর কাদিরা গ্রামের কৃষক আবুল কালাম ও কৃষক তুহিন জানান, গত বছরের আগস্টের ভয়াবহ বন্যার পর কৃষকরা ধান লাগাতে পারেননি। কেউ কেউ ৫-৬ বার বীজতলা তৈরি করেও ব্যর্থ হয়েছেন। কৃষকরা প্রথমে নিজের বীজ, পরে বাজারের বীজ এবং এমনকি, অনেকে সরকারি প্রণোদনার বীজেও ধান লাগিয়েছিলেন। কিন্তু সে ধানের গাছে ফলন আসছে না।
কেউ কেউ মনে করছেন, এবার বিলম্বে ধান লাগানো হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলছেন, ধানের জাতে গড় মিল হয়েছে।তবে যেটাই হোক, ফলন এন হওয়ায় এবার হাজার হাজার কৃষক একেবারে পথে বসে গেছেন।
কৃষকদের এমন পরিস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক সামছুদ্দিন মো: ফিরোজ বলেন, "বন্যার পর লক্ষ্মীপুর জেলাব্যাপী লাগানো আমন ধানের ৬০ ভাগে ফলন ভালো হয়েছে। তবে অনেক কৃষকের ধান নষ্ট হয়েছে শুনেছি।"
সুনির্দিষ্ট তথ্য দেওয়ার পর তিনি জানান, "আমন ধান আলোক সংবেদনশীল উদ্ভিদ। মূলত বিলম্বে লাগানোর কারণে এমন সমস্যা হয়ে থাকতে পরে। অন্যদিকে, প্রণোদনার ব্রিধান-৭৫ জাতে কোনো ফলন আসেনি বলে জানিয়েছেন কৃষকরা।"
জেলা ত্রাণ ও দূর্যোগ এবং কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের অগস্টে লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী ও ফেনী জেলায় ৩ ধাপে বন্যা হয়। এমন বন্যার কারণে লক্ষ্মীপুর জেলার ৮৩ হাজার ২০০ হেক্টর জমির মধ্যে মাত্র ৪৫,৭৭০ হেক্টর জমিতে আমন ধান লাগানো হয়েছিল। চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত এসব ধানের ৬০ ভাগ ঘরে তুলেছেন কৃষক।
কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, বন্যার কারণে লক্ষ্মীপুরে ১ লাখ ৫৭ হাজার ২০৯ জন কৃষক-কৃষাণীর ২২৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে ৬ হাজার কৃষককে ৫ কেজি ধানের বীজ, ২০ কেজি সার এবং ১ হাজার টাকা নগদ সহায়তা করা হয়েছিল।
কিন্তু কৃষকদের অভিযোগ, প্রণোদনা হিসেবে প্রদানকৃত ব্রিধান-৭৫ এবং বিআর-১৭ ধান ছিটা এবং কোনো ধানই হয়নি। এমন অভিযোগে কৃষি বিভাগ বলছে, অসময়ে লাগানোর কারণে এমন সমস্যা হয়েছে।