নারী উদ্যোক্তা তৈরির সরকারি প্রশিক্ষণে মিলছে না সুফল, প্রকল্প ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব
যশোরের অঞ্জনা সাহা এক হাজার টাকা ফি দিয়ে ছয় মাস মেয়াদি তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন সরকারি একটি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায়।
উদ্যোক্তা তৈরির লক্ষ্যে প্রকল্পটি নেয়া হলেও সরকারি উদ্যোগে এ প্রশিক্ষণ ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারেনি স্নাতকোত্তর পাস এ নারীর। উদ্যোক্তা হয়ে পারেননি আবার কোনো চাকরিতে যোগ দিতে । ফলে দীর্ঘ দিন ধরে বেকার জীবনযাপন করতে হচ্ছে তাকে।
অঞ্জনা সাহা জানান, জাতীয় মহিলা সংস্থার উদ্যোগে জেলাভিত্তিক মহিলা কম্পিউটার প্রশিক্ষণ প্রকল্পের আওতায় অফিস এ্যাপ্লিকেশন নিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তিনি। উদ্যোক্তা তৈরির লক্ষ্যে এ প্রকল্পটি নেওয়া হলেও, উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য এ প্রশিক্ষণ যথার্থ নয়।
অঞ্জনা সাহার মতো অনেক নারী জেলাভিত্তিক মহিলা কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিয়েও উদ্যোক্তা হতে পারেনি।
প্রকল্প অফিস থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, আট বছরে প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষণ নেওয়া নারীদের মধ্যে উদ্যোক্তা হয়েছে মাত্র 0.৬২% উদ্যোক্তা হয়েছে। আবার আউট সোর্সিং কাজে যুক্ত নারীদের হিসাব করলে এ হার ১.৮৭ %।
তবে প্রকল্পের ডাটাবেজের তথ্যের সঙ্গে বাস্তব চিত্রও ভিন্ন পাওয়া গেছে। প্রকল্পের ডাটাবেজে যেসব নারীদের উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিত করানো হচ্ছে, তাদের বেশির নারীই বেকার বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান।
আউটসোর্সিং কাজে যুক্ত আছে বলে দাবি হলেও বাস্তবে কেউ আউটসোর্সিংয়ে যুক্ত নেই বলে জানিয়েছেন প্রশিক্ষণ নেওয়া নারীরা।
বিশেষজ্ঞাদের মতে, উদ্যোক্তা তৈরি জন্য যে ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন , তা না থাকায় এ প্রকল্পে উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে না। এতে প্রকল্পের মাধ্যমে সরকারের কোটি কোটি ব্যয় হচ্ছে, কিন্তু প্রকল্পের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে না।
সারা দেশে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তথ্য প্রযুক্তি খাতে উদ্যোক্তা তৈরির উদ্দেশ্যে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কাজ শুরু হয় ২০১৩ সালে। জাতীয় মহিলা সংস্থার বাস্তবায়নাধীন এ প্রকল্পে ৬৯ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে গেছে। লক্ষ্য অর্জন না হলেও প্রকল্পের ব্যয় ও মেয়াদ তৃতীয়বারের মতো বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, শুরু থেকেই প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থী থেকে এক হাজার টাকা নিয়ে ভর্তি কার্যক্রম শুরু হয়। সরকারি বরাদ্দের মূল অর্থ ব্যয় হচ্ছে, জেলা পর্যায়ে অফিস ভাড়া, প্রশিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ও ভাতা পরিশোধে।
প্রকল্পের মাধ্যমে দুটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে প্রকল্পের আওতায়। এর মধ্যে একটি হলো কম্পিউটার অফিস এ্যাপ্লিকেশন কোর্স এবং অপরটি গ্রাফিক্স ডিজাইন এন্ড মাল্টিমিডিয়া প্রোগ্রামিং। মূলত মাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর পাস করা নারীরা এ কোর্সে এক হাজার টাকা দিয়ে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে। তবে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর নারীদেরই এসব কোর্সে ভর্তির আগ্রহ বেশি দেখা যাচ্ছে বলে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান।
বাংলাদেশ উইমেন ইন টেকনোলজির (বিডব্লিউআইটি) সাধারণ সম্পাদক রেজওয়ানা খান বলেন, উদ্যোক্তা তৈরি করতে হলে এখন শুধু কম্পিউটারের বেসিক বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিলেই হবে না। আরও উচ্চতর বিষয়েও প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
তিনি বলেন, মার্কেট পর্যালোচনা করে প্রশিক্ষণের বিষয় নির্ধারণ করতে হবে। এছাড়া যাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে, তাদের অবস্থা সম্পর্কে জেনে, তাদের কোথায় ঘাটতি রয়েছে তা চিহ্নিত করতে হয়। তা না হলে কোটি কোটি টাকাই খরচ হবে কিন্তু প্রশিক্ষণ থেকে কোনো সুফল আসবে না।
জাতীয় মহিলা সংস্থার এ প্রকল্পের মাধ্যমে গত আট বছরে প্রশিক্ষণ শেষ করে ৩২,৭৩১ জন নারী। এর মধ্যে প্রকল্প কর্তৃপক্ষের কাছে ৩০,৫৪১ জনের ডাটাবেজ রয়েছে।
জানা গেছে, প্রকল্প থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েও ২৮,৫৯০ জনই বেকার রয়েছে। সরকারি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি হয়েছে ৩৩৩২ জনের। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে আয় করছেন ৪০৮ জন নারী এবং উদ্যোক্তা হয়েছে মাত্র ২০৫ জন।
এদিকে এ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ নিয়ে যারা উদ্যোক্তা হয়েছে, তাদের বেশির ভাগেরই এখনও সফলতা আসেনি।
রংপুরের তানজিলা শারমিন কম্পিউটার অফিস অ্যাপ্লিকেশনের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। ২০১৫ সালে প্রশিক্ষণ নিয়ে উদ্যোক্তা হয়ে নিজেই প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ করেন তিনি। ব্যর্থ হয়ে এখন চাকরি সন্ধান করছেন বলে জানান তিনি। এই পরিণতি নাটোরের মাবিয়া খাতুন, গাজীপুরের অকেয়া সুলতানাসহ অনেকের।
ঝালকাঠি জেলার হাবিবা আক্তার এ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিনি নিজ বাসায় কম্পিউটার অফিস এ্যাপ্লিকেশন বিষয়ে প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করেছেন। এখন পর্যন্ত তার প্রশিক্ষণার্থী মাত্র তিন জন। এই অবস্থায় উদ্যাক্তা হিসেবে সফল হবেন কিনা তা নিয়ে তার শঙ্কা রয়েছে।
প্রকল্পের ডাটাবেজে রংপুরের নন্দিতা মুখার্জী, নরসিংদীর সুমি আক্তার, তানজিনা আফরিন, সাহরিন আকতার, পিরোজপুরের সানজিদা আখতার আউটসোর্সিংয়ে যুক্ত আছেন বলে উল্লেখ রয়েছে। এদের সবাই টিবিএসকে জানান, তারা কেউ কখনও আউটসোর্সিং কাজে যুক্ত ছিলেন না। এখনও কোনো কাজ করছেন না।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, যে কোনো চাকরিপ্রার্থীর কম্পিউটার অফিস এ্যাপ্লিকেশন বিষয়ে ধারণা থাকতে হবে। তবে চাকরি পাওয়ার জন্য এ ধরণের কোর্সে যথেষ্ট না।
একইভাবে মাত্র ছয় মাসের গ্রাফিক্স ডিজাইন এন্ড মাল্টি মিডিয়া প্রোগ্রামিং কোর্স করে চাকরি পাওয়া সহজ না। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এ বিষয়ে চার বছরের কোর্স করানো হয়। ফলে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেও চাকরি বা উদ্যোক্তা তৈরি হবে না , যদি না প্রশিক্ষণের বিষয়গুলো পরিবর্তন না করা হয়।
প্রকল্প পরিচালক নাজমুল হোসেন খান বলেন, বর্তমান পরিস্থিতির কারণে এমনিতে চাকরির সুযোগ কম। এ কারণে চাকরি তৈরি হচ্ছে না। তাছাড়া উদ্যোক্তা তৈরি হতে পুঁজির প্রয়োজন। জাতীয় মহিলা সংস্থা থেকে ঋণ দেওয়া হয়। কিন্ত এ প্রকল্পে ঋণের সুযোগ কম।
তিনি আরও বলেন, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের আওতায় এ প্রকল্পের মাধ্যমে দুটি কোর্সে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কোর্সের আওতা বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। তবে বর্তমানে চালু থাকা দুটি কোর্সে নারীদের ব্যাপক আগ্রহও রয়েছে। এ কারণে প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানো হচ্ছে।
এদিকে প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষণ নিয়ে কর্মসংস্থান তৈরি করতে না পারলেও তৃতীয়বারের মতো প্রকল্পটির ব্যয় মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। ইতিমধ্যে বৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভাও অনুষ্ঠিত হয়ছে। সভায় প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাবে সম্মতিও জানিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।
পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব), আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগ, মোসাম্মাৎ নাসিমা বেগম টিবিএসকে বলেন, গত সপ্তাহে প্রকল্প প্রস্তাবের ওপর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভা হয়েছে। সভায় প্রকল্পের ব্যয় ও মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাবে সম্মতি দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে প্রশিক্ষণের কারিকুলামে পরিবর্তন আনার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তবে এবার এটা সম্ভব হবে না। ভবিষ্যতে এ ধরণের প্রকল্পে কারিকুলামে পরিবর্তন করা হবে বলে তিনি জানান।
কর্মসংস্থান না হলেও প্রকল্পের ব্যয় আরও ৩২ কোটি টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব
শুরুতে এ প্রকল্পের ব্যয় ছিল প্রায় ৫২ কোটি টাকা। ১৯২০০ জন নারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার লক্ষ্য ছিল। ওই সময় জনপ্রতি প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থীর জন্য প্রকল্প থেকে ব্যয় করা হতো ২৭ হাজার টাকা।
পরে প্রকল্পের ব্যয় ৬০ কোটি টাকা করা হয়। একইসঙ্গে প্রশিক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ২৮০৭৯ জন করা হয়। জন প্রতি প্রশিক্ষণের ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ২২ হাজার টাকা।
এরপরে আবারও প্রকল্প সংশোধন করে ৪২২০৬ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার লক্ষ্যে ব্যয় বাড়িয়ে ৮৭ কোটি টাকা করা হয়। এতে প্রশিক্ষণার্থী প্রতি ব্যয় ধরা হয় ২১ হাজার টাকা।
প্রকল্পের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ নিয়েও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে না পারলেও সম্প্রতি প্রকল্পের ব্যয় আবার বাড়িয়ে ১১৯ কোটি করার প্রস্তাব দিয়েছে বাস্তবায়নকারী সংস্থা জাতীয় মহিলা সংস্থা । ইতিমধ্যে প্রকল্পের সংশোধিত প্রস্তাব অনুমোদনের সুপারিশও করেছে পরিকল্পনা কমিশন।