পাটকল বন্ধের এগারো মাসেও বকেয়া টাকা পাননি অস্থায়ী শ্রমিকেরা
মো. সুমন মিয়া (৩৫)- দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকগুলো বন্ধ করে দেওয়ায় বেকার হয়ে পড়া ৫০ হাজার শ্রমিকদের একজন। যৌবনের ৯টি বছর তিনি অস্থায়ী শ্রমিক হিসেবে শ্রম দিয়েছেন চট্টগ্রামের আমিন জুট মিলে। ২০১৫ সাল থেকে ২০২০ সালের জুলাই পর্যন্ত বিজেএমসি'র কাছে তার বকেয়া পাওনা প্রায় ১ লাখ ৬৯ হাজার টাকা। প্রায় এক বছর হতে চললেও ন্যায্য পাওনা না পেয়ে পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন সুমন।
তিনি বলেন, 'বকেয়া মজুরি পাবো- এই আশায় ধার-দেনা করেই গত এগারো মাস সংসার চালিয়েছি। এখন আর কেউ ধারও দেয়না। এভাবে চলতে থাকলে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই।'
ক্রমাগত লোকসানের কারণে ২০২০ সালের ২ জুলাই চট্টগ্রামের ৯টিসহ দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ২৫টি পাটকল বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সে সময় এসব পাটকলের প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের আওতায় অবসরের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিলো পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে।
মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, শ্রম আইন অনুযায়ী নোটিশ মেয়াদের ৬০ দিনের মজুরি। চাকরিবিধি অনুযায়ী প্রাপ্য গ্রাচ্যুইটি, পিএফ তহবিলে জমাকৃত অর্থ এবং নির্ধারিত হারে গোল্ডেন হ্যান্ডশেক সুবিধা পাবেন শ্রমিকরা।
একই সাথে ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত অবসরে যাওয়া ৮ হাজার ৯৫৬ জন শ্রমিক ও বদলি শ্রমিকদের সমুদয় পাওনাও এই সঙ্গে পরিশোধের ঘোষণা দেওয়া হয়।
এদিকে পাটকল বন্ধের পর থেকে শ্রমিকদের সকল পাওনা পরিশোধ ও বন্ধ পাটকল চালুর দাবিতে শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-জনতা ঐক্যের উদ্যোগে আন্দোলন করেছেন শ্রমিকরা। সভা সেমিনার ও মানববন্ধন করে নায্য দাবি উপস্থাপন করা হলেও তাতে কান দিচ্ছে না সরকার ও বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন (বিজেএমসি)।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রউফ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'অস্থায়ী শ্রমিকদের মূল বেতন পরিশোধ করা হয়েছে। তবে ঘোষিত মজুরি বোর্ডের আওতায় ২০১৫ সাল থেকে ২০২০ সালের জানুয়ারী পর্যন্ত সময়ের বর্ধিত মজুরি তাদের পাওনা আছেন। মূলত স্থায়ী শ্রমিকদের প্রায় ৭ শতাংশের পাওনা আমরা এখনো পরিশোধ করতে পারিনি। এ কারণে অস্থায়ী শ্রমিকদের টাকাটা দিতে বিলম্ব হচ্ছে।'
'ইতোমধ্যেই আমরা মন্ত্রণালয়ের কাছে তাদের জন্য অর্থ বরাদ্দের চিঠি পাঠিয়েছি। অর্থছাড় হলেই শ্রমিকরা তাদের পাওনা পাবেন। এছাড়া নাম জটিলতায় সারাদেশে ২ হাজার ৮০০ শ্রমিকের পাওনা আটকে আছে, বিষয়টি সমাধানে বিজেএমসি কাজ করছে।'
পাটকল রক্ষায় শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-জনতা ঐক্য পরিষদের সমন্বয়ক রুহুল বলেন, 'পাটকল বন্ধ ঘোষণার সময় সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিলো সে বছরের ১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে শ্রমিকদের পাওনা বুঝিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু স্থায়ী শ্রমিকরা কিছু পাওনা পেলেও অস্থায়ী শ্রমিকদের পাওনার বিষয়ে কোনো সুরাহা করছেনা বিজেএমসি ও সরকার। উল্টো আন্দোলনে নামা শ্রমিকদের বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হচ্ছে।'
তিনি বলেন, 'আমাদের হিসেবে বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত সারাদেশের পাটকগুলোতে ৩৫ হাজার অস্থায়ী শ্রমিক কর্মরত ছিলেন। বিজেএমসির হিসেবে এই শ্রমিকরা ৩ শত ২৩ কোটি টাকা পাওনা আছেন। মিল বন্ধের এগারো মাস পার হয়ে গেলেও অস্থায়ী শ্রমিকদের কোনো টাকা পরিশোধ করা হয়নি। বেকার হয়ে পরা এসব শ্রমিক বর্তমানে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন।'
চট্টগ্রামের আমিন জুট মিলের জিএম এ এইচ এম কামরুল হাসান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'বিজেএমসি ও অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ ছাড় না হওয়ায় আমরা টাকাটা দিতে পারছিনা। এছাড়া বিভিন্ন কারণে কয়েক মাসের মজুরী বকেয়া আছে, ধীরে ধীরে সেসব দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।'
শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৫ সালের ঘোষিত মজুরি কমিশন বাস্তবায়ন হয় ২০২০ সালের জানুয়ারিতে। এই ছয় বছরের বর্ধিত মজুরি (এরিয়া বিল) শ্রমিকরা পাওনা আছেন। ২০১৯ সালে বকেয়া আছে ৩ সপ্তাহের মজুরী, শ্রম আইন অনুযায়ী নোটিশ মেয়াদে ৬০ দিনের মজুরি, ২০২০ সালের ঈদুল আযহার বোনাস, প্রথম দফা লকডাউনের ৮ সপ্তাহের দিনভিত্তিক মজুরী ও ২০২০ সালের ১ ও ২ জুলাইয়ের দিনভিত্তিক মজুরী পাওনা আছেন শ্রমিকেরা।
জামাল হোসেন নামে একজন পাটকল শ্রমিক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'দীর্ঘ ২০ বছর ধরে আমিন জুট মিলে কর্মরত ছিলাম। জীবনের এই শেষ সময়ে এসে নিজের রক্ত-ঘামের বিনিময়ে অর্জিত টাকা পাচ্ছিনা। অর্থের অভাবে আমার শিশু সন্তানকে রিকশা চালাতে হচ্ছে, আমি নিজে ইট ভাঙতে হাতুড়ি হাতে নিয়েছি।'
শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-জনতা ঐক্য পরিষদ-চট্টগ্রামের সদস্য সচিব কামাল উদ্দিন বলেন, 'আমাদের শ্রমিকরা পাটকলের কাজ ছাড়া আর কিছুই জানেন না। দীর্ঘ একবছর ধরে বেকার শ্রমিকরা তাই অন্য কোন পেশায় নিজেদের মানিয়ে নিতে পারছেন না। এরই মধ্যে নতুন কাজে যোগ দিয়ে দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন শ্রমিক।'
সিবিএ নেতা আরিফুল রহমান বলেন,. 'পাটকল শ্রমিকদের মধ্যে অস্থায়ী শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশি দুর্দশাগ্রস্ত। অস্থায়ী শ্রমিকদের পাওনা কম, তাই উচিত ছিল তাদের পাওনাটাই সবার আগে পরিশোধ করা। কিন্তু স্থায়ী শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করা হলেও দীর্ঘ সময় পরেও অস্থায়ী শ্রমিকদের বিষয়ে পাওনার বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি, এটি অমানবিক।'