পুলিশে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও, বাড়েনি দায়িত্ব
১৯৭৪ সালে নারীরা প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ পুলিশে যোগ দিয়ে তৈরি করেছিল এক নতুন ইতিহাস। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে নারী পুলিশের সংখ্যা। কিন্তু খুব কম সংখ্যক নারী পুলিশই মনে করেন যে সংখ্যার সাথে সাথে তাদের উপর দায়িত্ব আরোপের পরিমাণও বেড়েছে।
ইতোমধ্যেই পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর (এসআই) হয়ে গেছেন এমন গুটিকয়েক নারী পুলিশই দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা অপরাধের তদন্ত করার দায়িত্ব পান। তবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের বিভিন্ন শাখা প্রায় নারী নেতৃত্বহীনই বলা চলে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নারী ও শিশু সম্পর্কিত অপরাধসমূহ, যেমন-ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি, এই ক্ষেত্রগুলোতে তদন্ত করার জন্য নারী পুলিশ থাকা অত্যাবশ্যক। বর্তমানে সারাদেশে ৭৯৭ জন নারী এসআই রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ পুলিশের ডেটা থেকে দেখা যায়, সত্যিকার চিত্রটি হলো এসব নারী এসআই এর সিংহভাগই কোনো মামলা তদন্ত করার সুযোগ পাননা বললেই চলে।
পুলিশের ইনস্পেক্টর জেনারেলের কার্যালয় থেকে হাইকোর্টকে পাঠানো এক রিপোর্ট থেকে জানা যায় বিগত পাঁচ বছরে দেশে মোট ২৬ হাজার ৬৯৫টি ধর্ষণ মামলা করা হয়েছে।
এ ধরনের মামলা দিনদিন বাড়তে থাকলেও মামলায় দেয়া দণ্ডাদেশের হার আগের মতোই অত্যন্ত কম। রিপোর্ট থেকে আরো জানা যায়, মামলাগুলোতে দণ্ডাদেশের হার এখনো মাত্র ৩ শতাংশ। ৯৭ শতাংশ ক্ষেত্রেই আসামী কোর্ট থেকে বেকসুর খালাস পেয়ে গেছে।
এই সকল মামলায় যদি নারী পুলিশ অফিসারদের দায়িত্ব দেয়া হতো তাহলে ভুক্তভোগী এবং সাক্ষীরা অনেক বেশি অভয় পেতেন আসামীর বিরুদ্ধে মুখ খুলতে। আর সেই সাথে এটি ন্যায়বিচারও নিশ্চিত করতে পারতো বলে মত বিশেষজ্ঞদের।
এ বিষয়ে নারী অধিকার আইনজীবী ব্যারিস্টার মিতি সানজানা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "নারীর উপর দমন-নিপীড়ন সংক্রান্ত মামলায় অবশ্যই নারী অফিসারদের তদন্ত করা উচিত। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই আমরা দেখি যে এসব মামলা পুরুষ অফিসাররা তদন্ত করে। নির্যাতিত নারীদের অধিকার ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা নিয়ে যারা কাজ করে তাদের জন্য এটি অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়।"
২০২১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশ পুলিশে মোট ১৫ হাজার ১৬৩ জন নারী পুলিশ সদস্য রয়েছে যা মোট পুলিশ সদস্যের মাত্র ৭ দশমিক ৯২ শতাংশ। যদিও বাংলাদেশ পুলিশ ২ লাখ ১২ হাজার জন পর্যন্ত নারী পুলিশ নিয়োগ দিতে পারবে। ২০১৯ ও ২০০৮ সালে নারী পুলিশের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১৩ হাজার ৪০২ জন এবং ২ হাজার ৫২০ জন।
পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ এর ডেপুটি ইনস্পেক্টর জেনারেল (প্রটেকশন অ্যান্ড প্রটোকল) আমেনা বেগম বলেন, "সাব-ইনস্পেক্টরদের তদন্তে পাঠানো হয় ঠিকই কিন্তু পুরো পুলিশ ফোর্সেই নারী এসআই এর সংখ্যা খুব কম। তাই দেশের প্রতি পুলিশ স্টেশনেই নারী এসআই নিয়োগ দেয়া সম্ভব হয়না। তবে সংখ্যায় কম হওয়া সত্ত্বেও নারী পুলিশরা তাদের দায়িত্ব চমৎকারভাবে পালন করে যাচ্ছেন।"
আমেনা বেগম 'বাংলাদেশ উইমেন পুলিশ নেটওয়ার্কে'রও সভাপতি। তিনি আরও জানালেন, "প্রতিটি পুলিশ স্টেশনেই নারী ও শিশু সংক্রান্ত কাজের ডেস্কে অ্যাসিস্টেন্ট সাব-ইনস্পেক্টর (এএসআই) নিয়োগ দেয়া রয়েছে। আমরা এএসআই নিয়োগ দিতে পারি কিন্তু এসআই পদের নিচে কাউকে দিয়ে তদন্ত করানোর অনুমতি আইনে নেই। আমরা যদি আর বেশি নারী এসআই নিয়োগ দিতে পারি তবেই এই সমস্যার সমাধান হবে।"
আমেনা বেগম মনে করেন, আমাদের নারী পুলিশেরা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। কম নারী পুলিশ থাকার বিষয়টি তাদের জন্য একটি বাধাস্বরূপ।
আমেনা বেগম স্মরণ করিয়ে দিলেন যে একজন নারী পুলিশ শুধুমাত্র পুলিশই নন, তারা কারো না কারো মা, বোন, মেয়ে কিংবা স্ত্রী এবং তাদের পরিবারের প্রতিও দায়িত্ব পালন করতে হয়। সে কারণেই নারী পুলিশের অনেক বেশি চ্যালেঞ্জ নিতে হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের একজন অ্যাডিশনাল ডেপুটি কমিশনার জানালেন যে বর্তমানে পুলিশ সুপারিনটেন্ডেন্টের সমান পদমর্যাদা নিয়ে ৭১ জন নারী পুলিশ রয়েছেন। কিন্তু ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অধীন গোয়েন্দা বিভাগ, অপরাধ বিভাগ এবং ট্রাফিক বিভাগে এখনো পর্যন্ত কোন নারী ডেপুটি কমিশনার নেতৃত্ব দিচ্ছেন না।
এই নারী পুলিশ কর্মকর্তার ভাষ্যে, "মনে হচ্ছে আমাদের রাখাই হয়েছে কম দায়িত্বশীল কাজগুলো করার জন্যে। কিছু সিনিয়র অফিসার তো মনে করেন যে আমরা বড় দায়িত্ব নেয়ার যোগ্যই নই। নারী পুলিশের সংখ্যা বাড়লেও তদন্ত কিংবা কোন অপারেশনে যাওয়ার ক্ষেত্রে তা স্বাভাবিকের চেয়েও কম।"
চট্টগ্রাম রেঞ্জের অধীনে উপকূলীয় জেলায় কাজ করেন এমন একজন নারী এএসপি জানালেন, "দূরবর্তী অঞ্চলগুলোতে আমি বেশিরভাগই ধর্ষণ মামলা নিয়ে কাজ করি। আমাদের আরো নারী অফিসার দরকার যেন ভিক্টিম ও সাক্ষীরা নির্ভয়ে তাদের কথা খুলে বলতে পারে আমাদের কাছে, যেন আরো বেশি তথ্য দিতে পারে অপরাধ সম্পর্কে।"
এ বিষয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টারের মিডিয়া বিভাগের অ্যাসিস্টেন্ট ইনস্পেক্টর জেনারেল মোহাম্মদ সোহেল রানা বলেন, নারী পুলিশের স্বল্পতার ব্যাপারটি নিয়ে কর্তৃপক্ষও চিন্তিত।
তিনি বলেন, "প্রতি বছর নারী পুলিশের সংখ্যা বাড়ছে। সেই সাথে মামলার তদন্তে নারী পুলিশের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টিও সমাধান হবে বলে আশা রাখি।"
- সংবাদটি ইংরেজিতে পড়ুন: Women in police: Participation increases, but not responsibilities
- অনুবাদ: খুশনুর বাশার জয়া