প্রতিকূল আবহাওয়ায় চা উৎপাদন কমার শঙ্কা
৯ কোটি ৬০ লাখ কেজি চা উৎপাদন করে গতবছর রেকর্ড গড়েছিল বাংলাদেশ। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৫ সালের মধ্যে ১৪ কোটি কেজি চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে চলতি বছরের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়েই শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, চা উৎপাদনের নিয়ামক শক্তি হচ্ছে, অনুকূল পরিবেশ, সঠিক বৃষ্টিপাত ও স্বাভাবিক তাপমাত্রা। বৃষ্টি এবং রোদের তাপ দুটোই চায়ের জন্য প্রয়োজন। কিন্তু চলতি বছরের প্রথম কয়েকমাস যেমন কোনো বৃষ্টি ছিল না আবার জুন-জুলাই মাসে প্রায় দিনই বৃষ্টি হওয়ায় এবং আকাশ মেঘাছন্ন থাকায় সূর্যের আলো পাচ্ছে না চা গাছ। ফলে রোদ-বৃষ্টির এ খেলায় পিক আওয়ারে (জুন থেকে সেপ্টেম্বর) উৎপাদন কমে আসতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস হলো চা উৎপাদনের প্রধান সময়। এই কয়েকমাস আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হওয়া অসম্ভব নয়। তবে উল্টোটা জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। তারা বলছে, জুলাই মাসের শেষের দিকে ভারী বৃষ্টিপাতের শঙ্কা রয়েছে। যার প্রভাব পড়বে চা উৎপাদনে।
বাংলাদেশ চা গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আবদুল আজিজ জানান, রাতে বৃষ্টি এবং দিনে রোদ চা উৎপাদনে নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। আকাশ যত মেঘলা থাকবে উৎপাদন কমার পাশাপাশি লোপারসহ বিভিন্ন পোকার আক্রমণ ততই বাড়তে পারে।
চা খাতের সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গত ডিসেম্বর থেকে টানা সাড়ে পাঁচ মাস এ অঞ্চলে বৃষ্টিপাত হয়নি। এতে প্রচণ্ড খরায় ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছে চা গাছ। মে তে বৃষ্টিপাত শুরু হলেও জুনে ২৫ দিনই ছিল বৃষ্টিপাত বা মেঘলা আকাশ।
জেরিন চা বাগানের ম্যানেজার সেলিম রেজা জানান, একমাত্র খরার কারণে শুধু মার্চ মাসেই তার বাগানে পঞ্চাশ শতাংশ চা উৎপাদন কম হয়েছে।
হামিদিয়া চা বাগানের জেনারেল ম্যানেজার সিরাজুল ইসলাম জানান, বছরের শুরু থেকে এবারের টানা খরায় আমাদের বাগানে মার্চ পর্যন্ত ৭৫ শতাংশ চা উৎপাদন পিছিয়ে ছিল, তবে পরে একটু উন্নতি হয়েছে।
বাংলাদেশ চা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে সাত কোটি ৫৯ লাখ ৪০ হাজার কেজি। গত ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন পর্যন্ত) উৎপাদন হয়েছে দুই কোটি ১৮ লাখ ৯ হাজার কেজি। গত বছর প্রথম ছয় মাসে ছিল দুই কোটি ৭৮ লাখ ৪৮ হাজার কেজি। ছয় মাসের হিসেবে দেখা যায়, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি বছর ৬১ লাখ ৩৯ হাজার কেজি চা কম উৎপন্ন হয়েছে। তবে আবহাওয়া বিরূপ আচরণ করলে বছর শেষে এই পার্থক্য আরও বড় আকার ধারণ করবে।
সূত্র আরও জানায়, গত বছর প্রথম পাঁচমাসে চায়ের যে উৎপাদন ছিল ঠিক তার পরের মাসের উৎপাদন ছিল আগের পাঁচ মাসের প্রায় সমান। ২০১৯ সালের জুন মাসে উৎপাদন ছিল এক কোটি ১৬ লাখ ৬৭ হাজার কেজি। চলতি বছরের জুন মাসে উৎপন্ন হয়েছে ৮৯ লাখ ৮৩ হাজার কেজি চা।
চা বাগান মালিকরা বলছেন, জুনে একমাসে ২৫ দিনই বৃষ্টি থাকায় তার প্রভাব পড়বে জুলাই এবং আগস্টের উৎপাদনে। ২০১৯ সালে জুলাই এবং আগস্টে উৎপন্ন হয় দুই কোটি ৪৬ লাখ ৯ হাজার কেজি; যা চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসের থেকে ২৮ লাখ কেজি বেশি ।
জুন থেকে সেপ্টেম্বরের পিক আওয়ারে চা উৎপাদন কমে গেলে পুরো বছরের লক্ষ্যমাত্রার ওপর বড় প্রভাব ফেলবে। চলতি বছরের জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল প্রতি মাসে এক কোটি কেজির বেশি।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের সহকারী পরিসংখ্যান কর্মকর্তা সাইদা বানু জানান, জুলাইয়ের হিসেব আগষ্টের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহে পাওয়া যাবে তখন বোঝা যাবে তফাৎ কতটা হয়েছে।
গত বছরের প্রথম ছয় মাসের তুলনায় চলতি বছর ৬১ লাখ ৩৯ হাজার কেজি চা উৎপাদন কম হয়েছে। জুনে বৃষ্টি থাকায় তার প্রভাব পড়বে জুলাই এবং আগস্টের উৎপাদনে।
এ ঘাটতি কিভাবে পূরণ হবে জানতে চাইলে বাংলাদেশ চা সংসদ সিলেট ভ্যালির সভাপতি জি এম শিবলি বলেন, জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত সাধারণত উৎপাদন কমই থাকে। এ বছর আবহাওয়ার কারণে কোনো কোনো বাগানের উৎপাদন ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কম হয়েছে।
''আমাদের চায়ের মৌসুম হচ্ছে জুন থেকে সেপ্টেম্বর। আবহাওয়া ভালো থাকলে এ সময় প্রতি মাসে এক থেকে দেড় কোটি কেজি চা উৎপাদন সম্ভব। আমরা আশা করছি, আবহাওয়া ভালো হলে বছর শেষে এই পার্থক্য কাটিয়ে উঠতে পারব। তবে আবহাওয়া ভালো না থাকলে এর উল্টোটি হবে'', যোগ করেন তিনি।
নাহার চা বাগানের জেনারেল ম্যানেজার পিযুষ কান্তি জানান, গত বছর আমার বাগানে চা উৎপাদন হয় দুই লাখ ৫৫ হাজার ৪৪৫ কেজি। এ বছর দুই লাখ ২০ হাজার কেজির লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে বৃষ্টি না থাকায় আমরা উৎপাদনে ৬৯ শতাংশ পিছিয়ে পড়ি।
তিনি আরও বলেন, তবে জুন মাসে কিছুটা কাটিয়ে উঠেছি। বর্তমানে আমরা লক্ষ্যমাত্রা থেকে ২৯ শতাংশ পিছিয়ে আছি। লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে কি-না তা নির্ভর করছে আবহাওয়ার উপর।
''গত বছর প্রথম ছয় মাসে আমার বাগানে ৬০ হাজার ৪৮৭ কেজি চা উৎপন্ন হয়। আর এ বছর মে পর্যন্ত উৎপন্ন হয়েছে ১৬ হাজার কেজির কিছু বেশি। তবে জুনে উৎপাদন ভালো হয়েছে'', যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের উপ-পরিচালক (পরিকল্পনা) মুনির আহমেদ জানান, আমদানি নির্ভর চা খাত গত তিন বছর ধরে রপ্তানিমুখী হয়েছে। করোনাভাইরাসের মধ্যে উৎপাদন অব্যাহত রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে সব বাগানে কীটনাশকসহ বিভিন্ন উপকরণ সরবরাহ করা হয়েছে।
''বছরের শুরুর দিকে আবহাওয়া খারাপ থাকলেও এখন অনেকটাই ভালোর দিকে। আশা করছি বছর শেষে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী চা উৎপাদন হবে'', বললেন মুনির আহমেদ।
সিলেট বিভাগীয় আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ আবহাওয়াবিদ সাইদ আহমেদ চৌধুরী জানান, এ বছর বৃষ্টির পরিমাণ গত বছরের মতো স্বাভাবিক আছে। তবে গত বছরের বৃষ্টিপাতের সময়টা ছিল চায়ের জন্য উপযোগী। আমরা আসলে কখন বৃষ্টি হচ্ছে সেটা হিসেব করি না, হিসেব করি কতটুকু বৃষ্টি হচ্ছে।
চলতি মাসে আরও বৃষ্টি হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ২১ জুলাই থেকে ভারী বর্ষণ হতে পারে। আগামী মাসগুলোতে রাতে নাকি দিনে বৃষ্টি হবে তার ওপর নির্ভর করছে চা উৎপাদনের ভবিষ্যৎ।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের সূত্র জানায়, ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনীছড়া চা বাগানে প্রথম বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চা চাষ শুরু হয়। দেশ স্বাধীনের সময় দেশে চা বাগানের সংখ্যা ছিল ১৫০টি। বর্তমানে সারাদেশে বিদেশি কোম্পানি, সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন ছোটবড় মিলিয়ে চা বাগানের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬৬টি। এর মধ্যে মৌলভীবাজারে রয়েছে ৯২টি। বাকিগুলো হবিগঞ্জে ২৪টি, সিলেটে ১৯টি, চট্টগ্রামে ২২টি, পঞ্চগড়ে সাতটি, রাঙ্গামাটিতে দুটি ও ঠাকুরগাঁওয়ে একটি।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে চায়ের চাহিদা বছরে ৯ কোটি কেজি। ২০১০ সাল থেকে এই চাহিদা পূরণ করতে চা আমদানি শুরু হয়। ২০১৫ সালে সর্বোচ্চ এক কোটি ১৪ লাখ কেজি চা আমদানি হয়। ২০১৬ সালে আট কোটি ৫০ লাখ কেজি পরিমাণ চা উৎপাদন করে বাংলাদেশ। ২০১৯ সালে চা-শিল্পের ১৬৫ বছরের ইতিহাসে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ চা উৎপাদনের রেকর্ড তৈরি হয়। সে বছর চা উৎপাদন হয় ৯ কোটি ৬০ লাখ ৬৯ হাজার কেজি।