ফেনীর দেড়শো বছরের সম্প্রীতিতে সাম্প্রদায়িকতার আঁচড়
রাজ বিজয় সিংহ দীঘির পাড়ের শহর ফেনী। শহরের প্রাণকেন্দ্র ট্রাংক রোডে কয়েক গজের মধ্যে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে ফেনী কেন্দ্রীয় বড় জামে মসজিদ ও শ্রী শ্রী কালী মন্দির। মসজিদটির ব্যবস্থাপনা কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল আলম গিটার জানালেন, মসজিদ ও মন্দির দুটির ইতিহাস প্রায় ১৪৫ বছরের পুরনো।
১৮৭৬ সালে ত্রিপুরার রাজা বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্য বাহাদুর ফেনী শহরে মন্দির ও মসজিদের জন্য ৫০ শতাংশ করে জমি বরাদ্দ দেন।
সে সময়ের টিনের ছাউনি থেকে আজকের কংক্রিটের ধর্মীয় উপসনালয় দুটি গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ধর্মীয় সম্প্রীতির উদাহরণ হয়ে। মাত্র কয়েকশ গজের ব্যবধানে একদিকে পূজা অর্চনা, আরেকদিকে আজানের ধ্বনি দুই সম্প্রদায়ের মধ্যকার বন্ধনকে দৃঢ় করছে প্রায় দেড়শো বছর ধরে। তবে গত শনিবারের ঘটনার পর কিছুটা হলেও আঁচড় লেগেছে এই সম্প্রীতি ও বন্ধনে।
ফেনী কেন্দ্রীয় বড় মসজিদের লাগোয়া তাকিয়া রোডে ১৯৭৩ সালের আগে থেকে ব্যবসা করছে রেনু ট্রেডার্সের মালিক নয়ন পালের পরিবার।
বুধবার নয়ন পাল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, গত শনিবারের আগেও এখানে মনে হয় হিন্দু-মুসলিমে কোনো তফাত ছিল না। 'মসজিদে নামাজ শেষে অনেক মুসলিমও আমাদের দোকানে কেনাকাটা করতেন, হিন্দুরা তো আসতেনই। তবে শনিবার যে আক্রমণ করা হলো সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর, তাতে করে সর্ম্পকে তো একটু হলেও চিড় ধরবে। অথচ শত বছরের ইতিহাসে ফেনীতে এমনটা হয়নি।'
মসজিদ মার্কেটের পাটোয়ারী ফ্যাশনের মালিক নুরুল হুদা জানান, তিনিও এখানে কখনও হিন্দু-মুসলমানে ভেদাভেদ দেখেননি। হিন্দুরাও তার দোকানে আসতেন নিয়মিতই। শনিবারের ঘটনা কিছুটা হলেও মনে দাগ কেটেছে। এ ঘটনার কোনো ব্যাখ্যা তার কাছেও নেই।
জেলা প্রশাসক ও মসজিদ কমিটির সভাপতি আবু সেলিম মাহমুদ উল হাসান টিবিএসকে বলেন, 'এটা কোনো ধর্মীয় বিরোধ নয়। তবে একটি দুষ্কৃতকারী চক্র ঘটনার সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করেছে। তবে এই সম্প্রীতি ছিল, আছে, থাকবে।'
শ্রী-শ্রী জয়কালী মন্দিরের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও শিল্পকলা একাডেমির সদস্য সমরজিত দাস টুটুল টিবিএসকে বলেন, কয়েক ঘণ্টার হামলায় শত বছরের ঐতিহ্যের বন্ধন যেন ম্লান হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, 'এখানে মন্দিরে প্রতি বছর পূজার সময় মসজিদ থেকে নামাজের সময়সূচি নিয়ে আসা হতো। নামাজ-আজানের সময় পূজার কার্যক্রম বন্ধ রাখা হতো। একইরকম সহাবস্থান ছিল মসজিদের দিক থেকেও। অথচ একদিনের ঘটনায় মনে যে দাগ কেটেছে, সেটা কীভাবে মুছবেন?'
'বলা হচ্ছে এখন পরিস্থিতি শান্ত। আদতে শান্ত হলেও, মন কি আর শান্ত হয়েছে? হিন্দুরা তো ভালো নেই-ই, মুসললমানদের মনেও এই ঘটনা দাগ কেটে গেছে। তারাও তো আমাদেরই ভাই,' সমরজিত বলেন।
আশরাফুল আলম গিটার বলেন, প্রকৃত মুসলমানরা এই হামলায় অংশ নেয়নি। কিছু বহিরাগত ও উচ্ছৃঙ্খল জনতা মন্দির ও আশপাশের এলাকায় ও দোকানে হামলা করে। সাময়িকভাবে কিছুটা প্রভাব পড়লেও দীর্ঘদিনের সম্প্রীতি নষ্ট হবার নয় বলেও মনে করেন তিনি।
সমরজিত বলেন, দশমীর বিসর্জন কোনোভাবে পার করলেও বুধবারের লক্ষ্মীপূজায় তাদের কোনো আনন্দ নেই। হারিয়ে ফেলেছেন প্রাণচাঞ্চল্য। 'মন্দির পূজা অর্চনার জায়গা, অথচ সেখানে পুলিশ বসে পালাক্রমে পাহারা দিচ্ছে। এ-ও কি সম্ভব?'
তবে এই সম্প্রীতি আবারো ফিরে আসবে বলে মত তার।
সমরজিত দাস শনিবার রাতের ঘটনার সাক্ষী। এশার নামাজের পর থেকে শুরু হওয়া হামলা শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত ছিলেন মন্দিরের ভেতরেই।
'আমরা মাত্র আটজন মানুষ ছিলাম ভেতরে। মসজিদের সামনে বিকেলের পর থেকে থমথমে পরিবেশ ঘোলাটে হতে থাকে। এশার নামাজের পর মসজিদের ছাদ ও মিনারের ওপর থেকে ইট-পাটকেল ছুড়ে মারা হয়।
'এক পর্যায়ে কলাপসিবল গেটের নিচ দিয়ে পেপার ছড়িয়ে দিয়ে ওপর থেকে প্লাস্টিক বোতলের মধ্যে আগুন দিয়ে পেট্রোল ছুড়ে মারা হয়। কোনোরকমে পানি দিয়ে আগুন নিভিয়েছি। পরে ইট-পাটকেলের আক্রমণের চোটে মন্দির অফিসের দেয়ালের পেছনে আশ্রয় নিই।' বলতে গিয়ে শিউরে ওঠেন সমরজিত।
তিনি বলেন, 'আমাদের গর্বের মসজিদ-মন্দিরের সহাবস্থান একদিনেই প্রশ্নের মুখে পড়ল। আমাদের পুরোহিত বিষ্ণুপদ চক্রবর্তীকে যেরকমভাবে ধুতি খুলে, কালেমা পড়তে বাধ্য করা হলো, তা তো একাত্তরকেও হার মানায়। সম্পূর্ণ পূর্বপরিকল্পিত এই হামলায় আমাদের নিয়ে খেলাধুলা হচ্ছে, আমরা এখন দাবার ঘুঁটি।'
তাকিয়া সড়কের আরেক দোকানদার বিষংকর পাল। তার পরিবার প্রায় ৫৮ বছর ধরে ব্যবসা করছে। তিনি বলেন, শুধু মন্দিরেই হামলা হয়নি, মসজিদের পাশের তাকিয়া রোডে বেছে বেছে প্রায় ১৬টি হিন্দু দোকান ভেঙে মালামাল লুটপাট করা হয়েছে। তার দোকানের নগদ তিন লাখ ৭৫ হাজার টাকাসহ লুট হয়েছে ৫ লাখ টাকার পণ্য।
ওই দোকানের কর্মী ও প্রত্যক্ষদর্শী শিমুল দাস টিবিএসকে জানান, রাত সাড়ে আটটার দিকে হঠাৎ পাশের শুঁটকি দোকানে হামলা দেখে দোকান বন্ধ করে কাছেই আশ্রয় নেন তিনি। দূর থেকে শস্যপণ্য ও মালামাল লুট করে নিয়ে যাওয়া দেখেন, প্রাণের ভয়ে বাধা দেওয়ার সাহস করেননি।
'এদের প্রত্যেকেই ১৮-২০ বছর বয়সী যুবক। এদের কেউই পরিচিত নয়। তারা শুধু হিন্দু দোকানেই আক্রমণ করেছে। ট্রাংক রোডের মোড়ে পুলিশ থাকলেও অনেকবার ৯৯৯-এ কল করার পরও পুলিশের কোনো সদস্য দোকানে হামলার সময় তাকিয়া সড়কের দিকে আসেননি। অনেকে বাসার সিসিটিভির ফুটেজে নিরুপায় বসে দোকান লুট, ভাঙচুর দেখেছেন,' তিনি বলেন।
বাঁশপাড়া দুর্গাপুজা মন্দিরের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ দে জানালেন, তারা এবার প্রতিমা বিসর্জন ঠিকমতো দিতে পারলেও শুধু প্রথম দুদিন ঠিকমতো পূজা করেছেন। বাকিটা সময় কাটিয়েছেন আতঙ্কে। বাড়ির নারী সদস্যদের খুব বেশি বাইরে না যেতে বলেছেন।
হিন্দু-বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি শুকদেবনাথ তপন বলেছেন, শায়েস্তা খাঁর আমল থেকে প্রতিষ্ঠিত মন্দির-মসজিদের সম্প্রীতি নিয়ে প্রশ্ন না থাকলেও গত শনিবারের হামলায় সেই প্রশ্ন উঠেছে, যেটা তিনি ইতিবাচকভাবে দেখছেন না।
বাবা আকাশ সাহার হাত ধরে বড় বাজার রাজকালী মন্দিরে লক্ষ্মীপূজা দেখতে এসেছে সাত বছরের শিশু নিবিড় সাহা। ভাঙা প্রতিমা দেখে তার প্রশ্ন, এগুলো এমন কেন? এই প্রশ্নের উত্তর তার বাবার কাছে নেই।
শনিবারের হামলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রাজকালী মন্দির। লক্ষ্মীপূজার জন্য সাজিয়ে রাখা সব প্রতিমা ভেঙে ফেলা হয়েছে। এখানকার পুরোহিতকেও হেনস্তা করে ভিডিও ছাড়া হয়েছে ফেসবুকে।
আকাশ সাহা বলেন, এমন অবস্থায় ভালো থাকার সুযোগ নেই। প্রতিবার লক্ষ্মীপূজায় তিনি গ্রামের বাড়ি হাজীগঞ্জ যান, এবার আর সাহস করেননি।
কী ঘটেছিল সেদিন
শনিবার আসরের নামাজের পর কেন্দ্রীয় বড় জামে মসজিদের পাশের জয়কালী মন্দির থেকে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের একটি প্রতিবাদ মিছিল করার কথা ছিল বলে জানান জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি ও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সুশেন চন্দ্র শীল।
একই সময়ে আসরের নামাজ হওয়ায় অনেক দেরিতেই মিছিলের প্রস্তুতি নেওয়া হয়। ওদিকে মসজিদের সামনে সাধারণ মুসল্লিদের ব্যানারে জড়ো হয় দুই শতাধিক তরুণ-যুবক। এদের বেশিরভাগই এখানে নিয়মিত নামাজ পড়ে না বলেও জানান সুশেন।
তিনি বলেন, 'পরে পুলিশের অনুরোধে প্রতিবাদ মিছিল সরিয়ে নেওয়া হলেও এই তরুণ-যুবকরা না সরায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। একই সময়ে আওয়ামী-যুবলীগের একটি মিছিল এসে মুসল্লিদের বাধা দিতে চাইলে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করলে দুই পক্ষের সংঘর্ষ বেধে যায়। তবে এতে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ-যুবলীগ বেশি আহত হয়। তবে মসজিদে আশ্রয় নেওয়ায় তাদেরকে সরিয়ে দিতে পারেনি পুলিশ।'
আওয়ামী-যুবলীগের মিছিল তাদের ধাওয়া না দিলে পরিস্থিতি এরকম না-ও হতে পারত বলে জানান সুশেন চন্দ্র শীল। এশার নামাজের পরপরই এসব তরুণ-যুবক দলে দলে মসজিদের ছাদে উঠে পাশের মন্দিরে হামলা করে। কিছু লোক পাশের দোকান ও মন্দিরগুলোতে হামলা চালায়।
'মসজিদের ছাদ থেকে আক্রমণ হওয়ায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়েছে। উপর থেকে ইট-পেট্রোল মারলে তা ঠেকানোর উপায় ছিল না,' বলেন সমরজিত দাস টুটুল।
এদিকে পুলিশ ও প্রশাসন শুরুতে আরো দায়িত্বশীল হলে হামলা ঠেকানো যেত বলেও মনে করেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান।
৪ মামলায় ১২ জন গ্রেপ্তার
হামলা-সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশ, র্যাব ও মন্দির কমিটির পক্ষ থেকে পৃথক ৪টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় বুধবার পর্যন্ত মোট ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
শনিবার রাতে শহরের মধ্যম রামপুর এলাকার নিজ বাড়ি থেকে সাইফুদ্দিন মাহমুদের ছেলে আহনাফ তৌসিফ মাহমুদ লাবিবকে (২২) গ্রেপ্তার করে র্যাব।
র্যাবের ভাষ্যমতে, লাবিব ওই ঘটনার উসকানিদাতা ও পরিকল্পনাকারী। তার সাথে সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্টতার থাকার কথা স্বীকার করেনি পুলিশ।
ফেনী মডেল থানার ওসি (তদন্ত) মো. মনির হোসেন টিবিএসকে জানান, র্যাব, পুলিশ ও মন্দির কমিটির পৃথক মামলায় গত তিন দিনে ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের আদালতের মাধ্যমে জেল-হাজতে পাঠানো হয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে প্রথম গ্রেপ্তার হওয়া ৬ জনকে অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে। আবেদনের শুনানি আগামী সোমবার অনুষ্ঠিত হবে।