বঙ্গবন্ধু মানমন্দির: মহাকাশ উপলব্ধি করতে চায় বাংলাদেশ
ভোগৌলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশের ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার ভাঙ্গারদিয়া গ্রামের দক্ষিণ অংশে মহাকাশ অবলোকন সেন্টার করবে সরকার। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্পেস অবজারভেটরি সেন্টার' নামে ১০০ মিটার উচ্চতার এই সেন্টারের মঞ্চ থেকে টেলিস্কোপের মাধ্যমে মহাকাশ অবলোকন করতে পারবেন দেশ-বিদেশের মানুষ।
এতে দেশ-বিদেশের বিজ্ঞান শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অ্যাস্ট্রনমি বা অ্যাস্ট্রফিজির অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণকারীরা এসে মহাকাশ বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করতে পারবেন। ভৌগোলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই এলাকা পরিদর্শন করতে বিদেশি পর্যটকদেরও আগমন ঘটবে বলে মনে করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। এজন্য ২২২ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প গ্রহণ করছে মন্ত্রণালয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিষুব রেখা, কর্কট ক্রান্তি রেখা ও মকর ক্রান্তি রেখা পৃথিবীকে পূর্ব-পশ্চিমে বেষ্টন করেছে। অন্যদিকে, চারটি দ্রাঘিমা রেখা- ০ ডিগ্রি, ৯০ ডিগ্রি পূর্ব, ১৮০ ডিগ্রি পূর্ব-পশ্চিম ও ৯০ ডিগ্রি পশ্চিম পৃথিবীকে উত্তর-দক্ষিণে বেষ্টন করেছে। পূর্ব-পশ্চিমে বেষ্টনকারী তিনটি রেখা এই চারটি দ্রাঘিমা রেখাতে মোট ১২টি বিন্দুতে ছেদ করেছে। এর ১০টি ছেদস্থল বিভিন্ন সাগর-মহাসাগরের উপরে অবস্থিত, স্থলভাগে আছে মাত্র দু'টি।
স্থলভাগের একটি ছেদস্থল পড়েছে সাহারা মরুভূমিতে, সেখানেও সাধারণের যাতায়াতের সুযোগ নেই। সহজে যাতায়াত করা যায়, এমন একমাত্র ছেদস্থল ভাঙ্গারদিয়ায় এ কেন্দ্র স্থাপন করা হলে বিদেশ থেকেও পর্যটকরা আসবেন। পদ্মা সেতু চালু হলে সেখানে যাতায়াতও খুব সহজ হবে।
এ প্রসঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ সফলভাবে উৎক্ষেপনের পর দূর মহাকাশ উপলব্ধি করতে চায় বাংলাদেশ। এজন্য ভৌগোলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ককর্ট ক্রান্তি ও ৯০ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমা রেখার মিলনস্থলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্পেস অবজারভেটরি সেন্টার স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। সেখান থেকে দেশ-বিদেশের মানুষ নক্ষত্রলোক ও মহাবিশ্ব অবলোকন করতে পারবেন। তবে চলমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে প্রকল্পটি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে বাস্তবায়ন সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে দ্বিধা রয়েছে।'
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ইতোমধ্যে প্রকল্পের ডিপিপি তৈরি করা হয়েছে, তাতে ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে এই সেন্টার স্থাপন সম্পন্ন করার কথা বলা হয়েছে। সম্প্রতি ডিপিপি নিয়ে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা হয়েছে।
কর্কটক্রান্তি রেখা ও ৯০ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমার মিলনস্থলের তথ্য গতবছর প্রথম উল্লেখ করেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী উদযাপন কমিটির সভায় ওই ছেদস্থলে 'বঙ্গবন্ধু মানমন্দির' স্থাপনের প্রস্তাব করলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তা গ্রহণ করেন। এজন্য প্রকল্প নিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেন তিনি। সেই প্রেক্ষিতেই এই অবজারভেটরি সেন্টার স্থাপনের প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. হাফিজা খাতুন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, কর্কট ক্রান্তি ও ৯০ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমা রেখা ফরিদপুরের ভাঙ্গায় ক্রস করেছে। অন্য ১১টি ছেদস্থল কোথায় তা বড় মানচিত্রের অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ রেখাগুলো দেখলে খুব সহজেই পাওয়া যাবে।
দেশে দ্য বাংলাদেশ স্পেস রিসার্চ অ্যান্ড রিমোট সেন্সিং অর্গানাইজেশন (স্পারসো) নামে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি মহাকাশ গবেষণা ও অনুধাবন কেন্দ্র রয়েছে, যা মহাকাশ বিজ্ঞান ও দূর অনুধাবন প্রযুক্তি, বন ও পরিবেশ, কৃষি, মৎস্য, ভূ-তত্ত্ব, মানচিত্র অংকন, ভূমি ব্যবহার, আবহাওয়া, ভূগোল ও সমুদ্রবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করে। এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় করে অবজারভেটরি সেন্টার স্থাপন করা হবে।
স্পারসোর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. মাহমুদুর রহমান জানান, কর্কট ক্রান্তি ও ৯০ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমার ছেদস্থল ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার একটি গ্রামে।
অন্য ১১টি ছেদস্থল কোন কোন সাগর-মহাসাগর বা ভূ-খণ্ডের ওপর সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সঠিকভাবে পর্যালোচনা না করে সুনির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়।
প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ১০ একর ভূমির ওপর ৫ তলা বৃত্তাকার (এনুলার) ভবন হবে। ওই ভবনের মাঝ থেকে পৃথক স্থাপনার উপর ভূমি থেকে ১০০ মিটার উচ্চতায় এক মিটার ব্যাসের মূল অবজারভেটরি টাওয়ার উপরে উঠে যাবে। ওই টাওয়ারে প্রতিফলক টেলিস্কোপের উপযোগী ১০ মিটার ব্যাসের একটি আনুভূমিকভাবে ঘূর্ণনক্ষম প্লাটফর্ম থাকবে। সেখান থেকে টেলিস্কোপের মাধ্যমে ওই ভাঙ্গার ছেদস্থলসহ মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করা যাবে। অবজারভেটরি টাওয়ারের নিচ তলা এবং বৃত্তাকার প্লাটফরমটি সহযোগী অবজারভেটরি হিসেবে কাজ করবে।
১০০ মিটার উচ্চতার তাৎপর্য হলো, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে এটি স্থাপিত হতে যাচ্ছে। ৫ তলা এনুলার ভবনে থাকবে অফিস কক্ষ, শ্রেণীকক্ষ, গবেষণাগার, থাকার আবাসগৃহ। প্রকল্প ব্যয়ের পুরোটা সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে যোগান দেওয়া হবে।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত পিইসি সভার সভাপতি ও পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য আবুল কালাম আজাদ বলেন, প্রকল্প স্থানটি ভৌগোলিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান হওয়ায় দেশি-বিদেশি পর্যটকরা প্রকল্প এলাকা ভ্রমণ করবেন বলে আশা করা যায়। সে বিবেচনায় প্রকল্প এলাকার সৌন্দর্যের দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন।
ভবনের নকশা আকর্ষণীয়ভাবে প্রণয়ন এবং সৌন্দর্য্য বর্ধনকারী গাছ রোপণের ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।
ডিপিপি ও পিইসি সভার তথ্য থেকে জানা যায়, প্রকল্পে ফার্নিচার, কম্পিউটারসহ বিভিন্নখাতে বাড়তি ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পে ১১ জন কর্মকর্তার জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশ ভ্রমণ ও প্রশিক্ষণে ১ কোটি ১০ লাখ টাকা বরাদ্দের প্রস্তাবের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে ওই সভায়। সেখানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মুনির চৌধুরী বলেন, রাজস্ব বাজেট থেকে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সেমিনার ও ওয়ার্কশপ করা হলে প্রকল্পের আওতায় বৈদেশিক প্রশিক্ষণ ব্যয় যৌক্তিকভাবে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
এসব বিষয়ে মুনির চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ডিপিপি সংশোধন করে বিভিন্নখাতে ব্যয় কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ফলে সামগ্রিকভাবে প্রকল্প ব্যয় কমতে পরে। একনেকে অনুমোদন পেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্পেস অবজারভেটরি সেন্টার স্থাপনের কাজ শুরু হবে।