বন্ধ নৌযান, বিপাকে শ্রমিকরা
'জমানো যে টাকা ছিল সব শেষ হয়ে গেছে। বাড়িতে কিভাবে টাকা পাঠাবো সেটা বুঝতে পারছি না। লঞ্চের মালিক খাবারের খরচ দেয়, সেই টাকা দিয়ে কোনমতে খেয়ে বেঁচে আছি', চোখে হতাশার ছাপ নিয়ে কথাগুলো বলেন সবুজ।
সবুজ 'এ্যাডভেঞ্চার ১১' লঞ্চের শ্রমিক (সুকানি)। তিনি বলেন, '৭ হাজার টাকা মাসে বেতন পাই। সেই বেতনের টাকা নিজে চলতেই লাগে। আমাদের ঘুমাতে (স্টাফ কেবিন) যে কেবিন দেয়া হয় সেই কেবিন মাঝে মাঝে ভাড়া দিয়ে যে টাকা পাই সেটা পরিবারের জন্য পাঠাই। লঞ্চ না চলায় সেটা আমরা পারছি না। গতবার কিছু রিলিফের চাল পেয়েছিলাম কিন্তু এবার কিছুই পাই নি। এমন লকডাইন আরও চললে পরিবার না খেয়ে থাকবে'।
সবুজ বলেন, 'আমাদের লঞ্চে কর্মী ৩০ জন কিন্তু এখন আমরা ১৫ জন আছি। লঞ্চ চলাচল বন্ধ তাই বাকি ১৫ জন ছুটিতে আছে'।
সরেজমিনে ঢাকার সদরঘাট ঘুরে দেখা গেছে, ঘাটের ভেতরে প্রবেশের টিকেট কাউন্টারগুলো সব বন্ধ। পল্টুনের পূর্ব-পশ্চিম সবদিকের শেষ দিকে সারি বন্ধ হয়ে কয়েকটি লঞ্চ পল্টুনের সঙ্গে বাধা। কিছু লঞ্চ নোঙর করে রাখা নদীর ওপারে।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল জেলার মানুষ যাতায়াতের জন্য ছুটে আসতেন ঢাকার সদরঘাটের এই নৌবন্দরে। সব সময় ভিড় লেগেই থাকতো এখানে। কিন্তু মহামারি করোনা রুখতে চলমান লকডাউন বদলে দিয়েছে সেই চিরচেনা চেহারা। সদরঘাটে এখন সুনসান নীরবতা।
'এ্যাডভেঞ্চার ১১' লঞ্চে্র চালক কামাল উদ্দিন বলেন, 'এখন লঞ্চে যাত্রী যাওয়ার মৌসুম। এখন লঞ্চ না চললে মালিক আমাদের বেতন দিবে কিভাবে। গতবারের দুর্দাশা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারি নি। সঞ্চয় ভেঙ্গে চলেছি'।
বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি মো. শাহ আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'করোনার সময়ে নৌযান শ্রমিকেরা পুরোদমে কাজ করেছেন। কিন্তু তাদের কাজের কোন মূল্যায়ন হয় না। নৌযান শ্রমিকদের প্রতিশ্রুত খাদ্য ভাতা দেওয়ার এখনো কোনো উদ্যোগ নেই'।
শাহ আলম বলেন, সারাদেশে যাত্রীবাহী লঞ্চের শ্রমিক আছে ৫০ হাজারের বেশি। এখন লঞ্চ চলাচল বন্ধ। মালিকরা কোন রকম খোরাকি (খাবারের জন্য টাকা) দেয়, সেটা দিয়ে খেয়ে না খেয়ে আছে'।
বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী আশিকুল আলম বলেন, 'শ্রমিকরা দুর্দাশায় রয়েছে। মালিকরা অনেক শ্রমিককে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। বেতন দিবে কি দিবে না সেটা এখনো বোঝা যাচ্ছে না। শ্রমিকরা কষ্টে আছে'।
চৌধুরী আশিকুল আলম জানান, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) থেকে গতবার শ্রমিকদের খাবার দেয়া হয়েছিল। এবার এখনও তারা সহায়তা পায় নি। গতবারের সংকট কোন রকমে শ্রমিকরা কাটিয়ে উঠেছিল। কিন্তু এবার কি হয় সেটা বলা যায় না। মালিকরা তো তাদের আয় থেকে বেতন দেয়। তাদেরই আয় না হলে শ্রমিকদের বেতন দিবে কীভাবে! দোকান খুলে দেয়া হচ্ছে। এখন অপেক্ষা লঞ্চ চলতে দেয়ার'।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লঞ্চে কাজ করা এক শ্রমিক বলেন, 'মোট শ্রমিকের প্রায় অর্ধেক শ্রমিক ছুটিতে পাঠিয়ে দিয়েছে মালিকরা । আর যারা ছুটিতে গেছে তাদের বেতন দেয়া হয় না। যারা বাড়িতে চলে গেছে তারা কষ্টে দিন পার করছে। শ্রমিকরা লঞ্চ চালুর জন্য প্রহর গুনছে'।
ঘাটে শ্রমিকের কাজ করা লিটন ব্যাপারি বলেন, '১০ বছর ধরে লঞ্চের মাল উঠা-নামার কাজ করছি। কিন্তু করোনা এসে সব এলোমেলো করে দিল। কোন কাজ নেই। তাই ভাড়ায় রিক্সা চালানো শুরু করেছি। কিন্তু পুলিশের বাঁধায় সেটাও পারছি না। আজও দুই ঘন্টা রিক্সা আটকে রাখা হয়েছে। দুপুর পার হয়ে বিকেল- এখন পর্যন্ত জমার টাকাও উঠাতে পারি নি। মাস গেলেই ৫ হাজার টাকা ঘর ভাড়া। সংসারের খরচ কিভাবে চালাবো জানি না'।
প্রসঙ্গত, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকার গণপরিবহন চলাচলসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ জারি করেছে। কঠোর বিধিনিষেধ দিয়ে 'সর্বাত্মক লকডাউন' শুরু হয় ৫ এপ্রিল থেকে। আগামী ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত এটি চলবে। লকডাউন শুরুর পর থেকে সারাদেশে লঞ্চ চলাচল বন্ধ রয়েছে। সরকারের নতুন নির্দেশনা না পাওয়া পর্যন্ত এ আদেশ বহাল থাকবে।