বাংলার বিখ্যাত বর্ষা মোকাবেলায় মেরিনার লড়াই!
বঙ্গোপসাগরের উত্তরে অবস্থিত ছোট একটি ব-দ্বীপ বাংলাদেশ। ষড়ঋতুর রানী আখ্যা পেলেও দেশের বিভিন্ন ঋতু বয়ে আনে নানা দুর্ভোগ। মূলত উপকূলীয় মানুষকে বর্ষা ঋতুতে সহ্য করতে হয় অকথ্য যন্ত্রণা। এই অঞ্চলের মানুষের সহায়তায় তাই একটি ভিন্নধর্মী ও টেকসই বাড়ির নকশা তৈরি করেছেন বাংলাদেশের স্থপতি মেরিনা তাবাসসুম।
প্রতি বছর জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ অঞ্চলের জলপথগুলো প্লাবিত থাকে। দেশের তিনটি প্রধান নদী- গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা এসে মিলিত হয় এই অংশে। তিনটি নদীর জলরাশির পাশাপাশি বৃষ্টিপাত চলতে থাকায় এই অঞ্চলে এসময় বিপর্যয়কর বন্যা চলে।
দেশের ভৌগলিক অবস্থানের কারণে হিমালয় থেকে আসা প্রবল হিমবাহের ফলেও বৃষ্টিপ্রবাহের মাত্রা বেশি থাকে। সম্প্রতি বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় এই দুর্ভোগ আরও বেড়েছে।
প্রবল বৃষ্টি এবং ভয়াবহ বন্যায় রাতারাতি ঘরবাড়ি ও জীবিকা হারিয়ে যায় এই অঞ্চলের মানুষের। তবে, এই দুর্যোগের ফলে নদীর তল থেকে উঠে আসা পলিমাটি নতুন চর তৈরি করে। সম্প্রতি সোয়েন মেডেলপ্রাপ্ত মেরিনার মতে, এই চরকে আদতে 'ভূমি' বলা যায় না।
"এটি একটি আর্দ্র জমি। তবে, ভূমিহীনদেরকে কয়েক বছরের জন্য আশ্রয় দেয় এসব চর।"
"একজন স্থপতি হিসাবে এই মানুষগুলোর প্রতি আমাদের দায়িত্ব রয়েছে। বর্তমানে বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের অর্ধেকই নির্গত হয় নির্মাণ শিল্প থেকে," বলেন তিনি।
ভূমিহীন চরের বাসিন্দাদের জন্য গত বছর এক ধরণের বাড়ির নকশা করেন মেরিনা ও তার দল। বাঁশের সাথে ইস্পাতের জয়েন্ট যুক্ত করে একটি সিঙ্গেল-স্পেস ফ্রেম তৈরি করেছেন তারা। 'খুদি বাড়ি' নামক এই বাড়িগুলোতে ৪ জনের একটি পরিবার থাকতে পারবে। এমনকি নিজেরাই এই বাড়িটি তৈরি করতে বা একে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিতে পারবে।
দুই তলা বিশিষ্ট এই বাড়ির উপরের তলায়ই থাকতে পারবেন বাড়ির বাসিন্দারা। বাড়িটি তৈরিতে বাঁশের পাশাপাশি ব্যবহৃত হয়েছে মাটি এবং স্থানীয় গাছের পাতা। একটি বাড়ি তৈরিতে খরচ পড়েছে প্রায় ৩৫ হাজার টাকা।
নতুন এই নকশাটি কীভাবে কাজ করবে তা পরীক্ষা করার জন্য দক্ষিণ-মধ্য বাংলাদেশের চর হিজলায় এ পর্যন্ত চারটি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। শীঘ্রই আরও ১০০টি বাড়ি স্থাপিত হবে এই অঞ্চলে।
১৯৬৯ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন মেরিনা। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশে বেড়ে ওঠার সময়ই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, মৃত্যু ও ধ্বংসের সাক্ষী হন তিনি। তিনি যে এলাকায় বড় হন, সেখানে এবং তার আশেপাশের এলাকায় একমাত্র চিকিৎসক ছিলেন তার বাবাই। ফলে, ছোট থেকেই মানুষের জন্য কাজ করার ইচ্ছা ছিল তার মধ্যে।
১৯৯৫ সালে আর্কিটেকচারে স্নাতক সম্পন্ন করা মেরিনা শহরের সুউচ্চ বাণিজ্যিক ভবন তৈরিতে আগ্রহী ছিলেন না। সে বছরই তিনি দেশের জলবায়ু এবং সংস্কৃতির সাথে সঙ্গতি রেখে ভবন নকশার পরিকল্পনা করেন। বাংলাদেশ স্বাধীনতা স্মৃতিস্তম্ভ এবং মুক্তি জাদুঘরের নকশা এবং ঢাকার ফায়দাবাদের বায়তুর রউফ জামে মসজিদের নকশা থেকে শুরু করে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ভবনের নকশা করেছেন মেরিনা। তার নকশায় মূলত খোলা ছাদ এবং বারান্দার ব্যবহার বেশি দেখা যায়।
বর্তমানে বাংলাদেশের কক্সবাজার অঞ্চলে বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী শিবিরে কাজ করছেন মেরিনা। এই অঞ্চলে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি সেখানকার বাঙালিদের জন্যেও খুদি বাড়ির মতো কম খরচে টেকসই বাড়ি নির্মাণের কাজ করছেন তিনি।
"শুধু দেশের ১ শতাংশ ধনী ব্যক্তির জন্য কাজ করলেই চলবে না। আমাদের উচিত প্রান্তিক মানুষদের সহায়তায় এগিয়ে আসা," বলেন মেরিনা।
- সূত্র- দ্য গার্ডিয়ান