বিদেশ প্রশিক্ষণের নামে আনন্দ ভ্রমণ ও কেনাকাটা
উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে বিদেশ ভ্রমণে গেলেও বেশির ক্ষেত্রে সরকারি কর্তকর্তাদের মূখ্য বিষয় হয়ে ওঠে আনন্দ ভ্রমণ ও কেনাকাটা করা। এতে সরকারি কর্মকর্তাদের দক্ষতা বাড়ানোর নামে অর্থের অপচয় হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় সংসদে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। এছাড়া উন্নয়ন প্রকল্পে বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে সরকারি অর্থ অপচয় নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে কমিটি।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির সভায় কমিটির সদস্যরা এ উদ্বেগ জানান। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পকির্ত স্থায়ী কমিটির সভাপতি আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে কমিটির সদস্য পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানসহ কমিটির অন্য সদস্যারা এতে উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকের কার্যবিবরণী থেকে এসব তথ্য জানা গেছে, যা গত সপ্তাহে প্রকাশিত হয়।
সভায় স্থায়ী কমিটির সভাপতি বলেন, অনেক কর্মকর্তাই বিষয়বস্তু না জেনেই উচ্চ প্রশিক্ষণে বিদেশ যাচ্ছেন সরকারি কর্মকর্তারা। ফলে প্রশিক্ষণের চেয়ে ভ্রমণ বা কেনাকাটা করাই মূল উদ্দেশ্য হয়ে ওঠে। এ কারণে যেসব কর্তকর্তারা একান্তই প্রকল্পের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত কেবলমাত্র তাদেরই প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশ পাঠানো উচিত।
কমিটির সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, দক্ষতা বাড়ানোর লক্ষ্যে কর্মকর্তাদের দেশে-বিদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো দেওয়া হয়। কিন্তু প্রশিক্ষণের থেকে অর্জিত জ্ঞান কতটুকু ব্যবহার করতে পারছেন তার কোনো পরিসংখ্যান সরকারের কাছে নেই।
তিনি আরও বলেন, এ অবস্থায় এখন থেকে যারা দেশে বা বিদেশে প্রশিক্ষণে যাবেন তাদের অর্জিত জ্ঞানের বিষয়ে অবশ্যই একটি প্রতিবেদন যথাযথ কতৃপক্ষকে জমা দিতে হবে। বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফেরে অনেক কর্মকর্তা অনেক সময় অন্য কোনো মন্ত্রণালয় , বিভাগ বা সংস্থায় বদলি হয়ে যাচ্ছেন। এতে অর্জিত জ্ঞান কাজে আসছে না।
বৈঠকে প্রকল্প প্রস্তাব প্রণয়ন ও ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তুলে সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে কী পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়? ব্যয় কিভাবে নির্ধারণ হয়? সিভিল এভিয়েশনের একটি প্রকল্প একই বছরে ৭ হাজার কোটি টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৫ হাজার কোটি টাকা হয়। একটি প্রকল্প একই বছরের মধ্যে দ্বিগুণ হয়ে যায়- এ ধরনের প্রকল্প কিভাবে অনুমোদন পায়? সে বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
এ সাংসদ আরও বলেন, টাকা বৃদ্ধি পেলেও কাজের মান মোটেও বাড়ে না। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ না হতেই অবকাঠামো ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। এতে সরকার আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। প্রকল্পের কাজে নজদারি বাড়াতে মন্ত্রণালয়গুলোতে একটি আলাদা তদারকি সেল গঠন করা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে আবুল কালাম আজাদ বলেন, প্রত্যেকটি প্রকল্পের মূল্যায়নের ব্যর্থতার কারণে খরচ এবং সময় দুটোই বেড়ে যায়। একটি প্রকল্প তিন থেকে চার বার সময় বাড়ানো হয়।
সংসদ সদস্য রওশন আরা মান্নান বলেন, কোনো কোনো প্রকল্প ৬ বার পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। তিনি আরও বলেন, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও বস্তি এলাকায় জনসংখ্যা অপরিকল্পতভাবে বেড়ে যাচ্ছে। তাদের জন্য প্রকল্প নিতে হবে।
সংসদ সদস্য মনজুর হোসেন বলেন, বাস্তবায়ন কিংবা অর্থ ব্যয়ের ওপর নির্ভর করে প্রকল্পের গতিশীলতা। প্রসাশসিক জটিলতা ও দুর্নীতি বন্ধ করতে পারলে সরকারি কার্যক্রমে গতি আনা সম্ভব। তিনি বলেন, ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে সরকারি কাজে অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতি কমে গেছে।
সংসদ সদস্য রফিকুল ইসলাম বলেন, দশম সংসদে (গত সংসদ) পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থানীয় কমিটির বৈঠকে যে সব রাস্তা হাট-বাজারের মধ্য দিয়ে যায়, সেসব জায়গায় পানি জমার সম্ভাবনা থাকে, সেসব রাস্তা বিটুমিনের পরিবর্তে কংক্রিটের রাস্তা নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়নি।
তিনি আরও বলেন, অনেক মন্ত্রণালয় অর্থের অভাবে উন্নয়নমূলক প্রকল্প গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। আবার অনেক মন্ত্রণালয়ে অর্থের অভাবে উন্নয়নমূলক প্রকল্প নেওয়া যাচ্ছে না। যে সব মন্ত্রণালয় বা বিভাগ অর্থ ব্যয় করতে পারছে না ,সেগুলোকে চিহ্নিত করা উচিত। একই সঙ্গে সেসব মন্ত্রণালয় কাজের চাহিদা বেশি তাদের বেশি বরাদ্দ দেওয়া উচিত।
সংসদ সদস্য হাফিজ আহমদ মজুমদার বলেন, অনেক সময় বৈদেশিক ঋণের অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হয় না। এ জন্য আরও নজরদারি বাড়ানো দরকার। এছাড়াও প্রকল্পের দুর্নীতি বন্ধ করে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
পরিকল্পনামন্ত্রী এম. এ. মান্নান বলেন, সংসদীয় কমিটির কাজ হচ্ছে মন্ত্রণালয়ের কাজ পর্যালোচনা করা, কোনো গুরুত্বপূর্ণ অনিয়ম এবং অভিযোগ তদন্ত করে সামগ্রিকভাবে মন্ত্রণালকে পরামর্শ দেওয়া বা সুপারিশ করা। কমিটিতে যে কোনো তথ্য উপস্থাপনের আগে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়েরর আওতায় বিভিন্ন বিভাগের কর্তকর্তাদের অধিক সতর্কতা অবলম্বন ও হালনাগাদ তথ্য উপস্থাপনের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন তিনি।