বিসিকের বিষাক্ত বর্জ্যে নষ্ট হচ্ছে ফসল, হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য
ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিসিকের বিভিন্ন কারখানার অপরিশোধিত শিল্পবর্জ্যে নষ্ট হচ্ছে আশেপাশের প্রায় ৩০ একর জমির ফসল। কেমিক্যাল মিশ্রিত বিষাক্ত পানি সরাসরি ড্রেনের মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী খালে ছাড়ার কারণে হুমকির মুখে পড়ছে এলাকার জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ।
এর প্রভাবে বিসিক এলাকার আশেপাশে বেড়েছে চর্মরোগসহ বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব। রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ছে হাঁস-মুরগি-গবাদিপশু। এলাকাবাসীর অভিযোগ, প্রায় দুই যুগ ধরে চলা এই সমস্যার সমাধানে সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে বারবার আশ্বাস দেওয়া হলেও দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
বিসিক তথ্য সূত্রে জানা গেছে, জেলার সদর উপজেলার নন্দনপুর এলাকায় ১৯৮৫-৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বিসিক শিল্পনগরী। প্রায় ২১.৯৮ একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত ওই শিল্পনগরীতে অনুমোদিত ৭২টি কারখানার মধ্যে বর্তমানে ৬৬টি চালু রয়েছে। এর মধ্যে ২টি ওষুধ, ৪টি সিলিকেট, ২টি সাবান, ৪টি মেটাল, ৩টি বিস্কুট, ৪টি সরিষার তেল ও ৮টি ময়দার কারখানাসহ বিভিন্ন কল-কারখানা রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মূলত সাবান এবং সিলিকেট কারখানা থেকেই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকারক বর্জ্য উৎপন্ন হয়। কেমিক্যাল মিশ্রিত এই বর্জ্য শিল্পনগরী সংলগ্ন ছাদিরপুর গ্রামের বাসিন্দাদের দুর্ভোগের মূল কারণ। গ্রামটিতে প্রায় পাঁচ শতাধিক মানুষের বসবাস। এর ফলে প্রতি মৌসুমেই নষ্ট হচ্ছে গ্রামের ৩০ একর জমির ফসল।
প্রতিদিন শিল্পনগরীর বিভিন্ন কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য পরিশোধন ছাড়াই ছোট ড্রেনের মাধ্যমে ছাড়া হয় কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়ক সংলগ্ন খালে। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, রাসায়নিক মিশ্রিত বর্জ্যরে কারণে খালের পানির রঙ কালচে হয়ে গেছে।
এলাকাবাসী জানায়, ওই পানিতে নামলেই তারা বিভিন্ন চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। পাশাপাশি গবাধি পশু ও হাঁস-মুরগি মারা যাচ্ছে। কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি খালের মাধ্যমে আবাদি জমিতে গিয়ে পড়ার কারণে প্রতিবছর ছাদিরপুর গ্রামের অন্তত ৩০ একর জমির ধানসহ বিভিন্ন রবি শস্য নষ্ট হচ্ছে। অব্যাহত লোকসান ও ফসল ঘরে তুলতে না পারায় অনেক কৃষক বিভিন্ন কারখানা মালিকের কাছে জমি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। গ্রামের অনেক বাসিন্দা গবাধি পশু পালনও ছেড়ে দিয়েছেন। এছাড়া কেমিক্যাল মিশ্রিত বর্জ্য ও পানির কারণে খালপাড়ের গাছপালাও মারা যাচ্ছে। এতে হুমকির মুখে পড়েছে স্থানীয় পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য।
নিয়ম অনুযায়ী কারখানার বর্জ্য ইফলুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের (ইটিপি) মাধ্যমে পরিশোধন করার কথা থাকলেও বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান তা তোয়াক্কা করে না। সম্প্রতি প্রশাসনের চাপে কয়েকটি কারখানায় ইটিপি প্ল্যান্ট স্থাপন করা হলেও সেগুলো ঠিকমতো পরিচালনা না করায় সমস্যার সমাধান হয়নি।
ছাদিরপুর গ্রামের আবদুল মালেক নামে এক বৃদ্ধ জানান, প্রায় ৩৫ বছর ধরে তিনি ছাদিরপুর গ্রামে বাস করছেন। বিসিক শিল্পনগরী হওয়ার পর থেকেই কষ্ট করতে হচ্ছে তাদের।
তিনি জানান, বিষাক্ত বর্জ্যরে কারণে জমির ধান নষ্ট হচ্ছে। ফলে লোকসান দিয়ে ধান বিক্রি করতে হয়। তাই কয়েকবছর আগে তার চাষযোগ্য ১৬ শতাংশ জমি একটি পেট্রোল পাম্পের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। দীর্ঘদিনের এই সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের কাছে দাবি জানিয়েছেন তিনি।
হাদিস মিয়া নামে আরেক কৃষক বলেন, বিষাক্ত বর্জ্য মিশ্রিত পানির কারণে আমাদের গরু-ছাগল ও হাঁস-মুরগি মারা যায়। ‘‘বছর তিনেক আগে আমার একটি গরু মারা গেছে। তখন থেকে আরা গরু পালন করিনা। পাশাপাশি আমাদের অনেকেই চর্মরোগে ভুগছে।’’
সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. আবু সাঈদ বলেন, বর্জ্য মিশ্রিত ওই পানিতে আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম ও ক্রোলিনসহ নানা ক্ষতিকারক উপাদান থাকে। ‘‘ওই পানি যখন হাঁস-মুরগি ও গবাধিপশু পান করে তখন চর্মরোগ ও চামড়া প্রদাহসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়। এমনকি মারাও যায়।’’
জুলহাসুর রহমান নামে গ্রামের এক বাসিন্দা জানান, ওই এলাকায় তার প্রায় ৬ একর জমি রয়েছে। ঢাকায় চাকরির কারণে সব জমি বর্গা দিয়ে রেখেছেন। তবে বর্গাচাষীরা বিষাক্ত পানির কারণে জমিতে ফসল ফলাতে পারে না। বৃষ্টির সময় খালের পানি গিয়ে জমিতে পড়ে। এতে জমির ফসল নষ্ট হয়ে যায়।
নিলুফা বেগম নামে গ্রামের এক গৃহবধূ বলেন, বিষাক্ত পানির দূর্গন্ধে আমাদের ঘরে থাকা দায় হয়ে পড়েছে। ‘‘ছেলে-মেয়েসহ বাড়ির সবাই আমরা চর্মরোগে ভুগছি। আমাদের হাঁস-মুরগি পানিতে নামলেই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। আমরা এই সমস্যা থেকে মুক্তি চাই।’’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. শওকত হোসেন বলেন, বিসিক শিল্পনগরী সংলগ্ন গ্রামের অনেকেই আমাদের কাছে প্রায়ই এলার্জি, অ্যাক্সিমা, ডার্মাটাইটিস ও সোরিয়াসিসহ বিভিন্ন চর্মরোগের চিকিৎসা নিতে আসেন। ওই রাসায়নিক মিশ্রিত পানির কারণে মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারাও যেতে পারেন।
ইউসুফ মিয়া নামে ক্ষতিগ্রস্ত এক কৃষক জানান, চলতি মৌসুমে ৬০ শতাংশ জমিতে তিনি ধান, আলু ও ধনেপাতা চাষ করেছিলেন। কিন্তু বিষাক্ত পানির কারণে বেশিরভাগ ফসল নষ্ট হয়ে গেছে।
৩০ একর জমির ফসল নষ্ট হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক আবু নাছের বলেন, ‘‘বিষয়টি আমাদের নলেজে রয়েছে। এগুলো বন্ধ করার জন্য আমরা উন্নয়ন সভায় রেজুলেশন করেছি। তাদেরকে ইটিপি ব্যবহার করতে আমাদের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে।’’
বিষাক্ত বর্জ্যরে কারণে ক্ষতির কথা স্বীকার করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিসিক শিল্পনগরী মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জামাল উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ‘‘আমাদের পাঁচটি কারখানা থেকে রাসায়নিক বর্জ্য বের হয়। তবে জেলা প্রশাসনের চাপে ওই কারখানাগুলোতে ইটিপি স্থাপন করা হয়েছে, যা এখনও চলমান রয়েছে।’’ তবে এখন যে বর্জ্য বের হয় সেগুলো বিষাক্ত নয় বলে দাবি করেন তিনি।
তবে কারখানা মালিকরা সঠিকভাবে ইটিপি পরিচালনা করেননা উল্লেখ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিসিক শিল্পনগরী কর্মকর্তা ফজলুল হক বলেন, ‘‘পাঁচটি কারখানায় ইটিপি স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু তারা সেগুলো ঠিকমতো চালায় না।’’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পরিবেশ অধিদফতরের উপপরিচালক শওকত আরা কলি বলেন, ‘‘ইটিপি ব্যবহার করে কী-না সেটি তো প্রতিদিন গিয়ে দেখা সম্ভব নয়। শিল্পনগরী কর্তৃপক্ষ যেহেতু সেখানে থাকে, তারা যদি আমাদের সহযোগীতা করেন তাহলে কাজ সহজ হয়। আমরা মাঝে-মধ্যে গিয়ে দেখি, বন্ধ পেলে ব্যবস্থা নেই।’’ শিল্পনগরীর বর্জ্য পরিশোধনের জন্য একটি সমন্বিত ইটিপির প্রয়োজন বলেও জানান তিনি।
বিষাক্ত বর্জ্যরে কারণে স্থানীয়দের যে সমস্যা হয় তা আমরা গুরুত্ব দিয়ে দেখছি জানিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পঙ্কজ বড়–য়া বলেন, ‘‘কারখানাগুলোতে ইটিপি সঠিকভাবে পরিচালনা নিশ্চিতকরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যদি কেউ ইটিপি না চালায় তাহলে বিধি মোতাবেক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’’