বরিশাল বিসিক: গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটে বাধাগ্রস্ত উৎপাদন
১২ মাসে ৭০ লাখ টাকা লাভ নয়, লোকসান! এই লোকসান গুনতে হয়েছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প (বিসিক) বরিশালের উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠান বিসমিল্লাহ পলিমার অ্যান্ড প্যাকেজিংকে। নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ না থাকা, ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাট ও উচ্চ বিদ্যুৎ বিলের কারণে বছরঘুরে এ লোকসান গুনতে হয়েছে বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির মালিক।
বিসমিল্লাহ পলিমার অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের প্রধান নাজমুন নাহার রিনা বলেন, "এই সমস্যাগুলো না থাকলে আমার এক টাকাও লস হতো না। বরং উৎপাদন বাড়াতে পারতাম।"
নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ যেকোনো শিল্প অঞ্চল প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত হলেও প্রতিষ্ঠার ছয় দশকের মধ্যে (১৯৬১ সাল থেকে) এখনো কারখানা স্থাপনের উপযোগী হয়ে উঠতে পারেনি বরিশাল বিসিক।
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর বরিশাল বিসিকের গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা কেন্দ্রে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা আরও বেড়েছে। বন্ধ থাকা ইউনিটগুলো এখন আবারও চালু হয়েছে। নতুন উদ্যোক্তারাও কারখানা স্থাপনে আগ্রহ দেখাচ্ছেন।
বিসিক সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে এখানে ৪৭০টি প্লট রয়েছে। ১৭৭ জন ব্যক্তির অনুকূলে এরমধ্যে ৩৭৭টি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। উৎপাদনে আছে ১২৬টি শিল্প ইউনিট।
কারখানার মালিক ও খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই সমস্যাগুলো যেকোনো শিল্প এলাকার উন্নয়নকেই বাধাগ্রস্ত করে।
নাজমুন নাহার রিনা বলেন, "গ্যাস না থাকায়, বিদ্যুৎ স্টেশন চালু না থাকায় উৎপাদনমুখী কারখানাগুলো বড় ব্যাধিতে আক্রান্ত। পরিস্থিতি এখন এমন যে, এসবের অভাবে না পারছি ঠিকভাবে কারখানা চালাতে, না পারছি পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে। এই অঞ্চলের বেশিরভাগ কারখানা মালিকরা একই সমস্যায় ভুগছেন।"
আরেক কারখানা মালিক জামাল হোসেন বলেন, "গ্যাস না থাকায় প্রতিটি পণ্য উৎপাদনে বাড়তি খরচ গুনতে হচ্ছে। আমাদের খরচ কম হলে অনেক কম দামে পণ্য বাজারজাত করা যেত। এখন সীমিত আয়ে টিকে থাকতেই কারখানা চালিয়ে রাখতে কষ্ট হচ্ছে। গ্যাসের দাবিতে এমপি-মন্ত্রীর কাছে অনেকবার গিয়েছি। তাদের প্রচেষ্টা থাকলেও আমরা গ্যাস পাচ্ছি না।"
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান রিফাত ফেরদৌস বলেন, "পদ্মা সেতু চালুর পরে বরিশাল বিসিকে বিনিয়োগ বেড়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে, এখানকার কর্মপরিবেশ সৃষ্টি হয়নি।"
"এখানে আর্ন্তজাতিকমানের কয়েকটি উৎপাদন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলো সুন্দরভাবে চলতে হলে যেসব মৌলিক সাপোর্ট দরকার তা না থাকাটা হাতাশার।"
ভোলাতে গ্যাস আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, "সেই গ্যাস যদি বরিশালে সরবারহ করা হয়, তাহলে উৎপাদন যত বাড়বে পণ্যের দামও কমবে। এর পাশাপাশি শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ, কর্মস্থল ও আশপাশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।"
শুধু গ্যাস আর বিদ্যুতের অভাবই নয়, এখানে পরিকল্পিত কোনো ড্রেনেজ ব্যবস্থাও নেই। শ্রমিকদের চিকিৎসার জন্য স্বাস্থ্য কেন্দ্র নেই। নেই দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের স্টেশন। নিরাপত্তার জন্য নেই কোনো পুলিশ ফাঁড়িও।
অর্থনীতি বিশ্লেষক অধ্যাপক পান্না লাল রায়ও অনেকটা একই কথা বললেন। তিনি বলেন, অর্থনীতি সচল রাখতে হলে উৎপাদনমুখী কারখানাগুলোর ওপরে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। শুধু গুরুত্ব নয় উৎপাদনমুখী কারখানাগুলো যেন ঠিকভাবে সচল থাকতে পারে, সেজন্য উপযোগী পরিবেশ, জ্বালানি সরবারহ নিশ্চিতের ব্যবস্থা করতে হবে।
"বরিশাল বিসিকে গ্যাস নেই, বিদ্যুৎ স্টেশন নেই, আলাদা ফায়ার স্টেশন নেই— অথচ প্রতিটি বিষয়ই গুরুত্বপূর্ণ। গ্যাস ও বিদ্যুৎ স্টেশন থাকলে উৎপাদনে বিঘ্ন হতো না। বাজারেও কমমূল্যে পণ্য পাওয়া যেত। কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতো। ফায়ার সার্ভিস থাকলে দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম হতো। কিন্তু বিসিক আছে অথচ কারখানা সচল রাখতে আয়ত্বের মধ্যে জ্বালানি ও দুর্ঘটনা প্রতিরোধ ব্যবস্থা না থাকায় মুনাফা খাটিয়েও মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে অর্থনীতির," যোগ করেন তিনি।
বিসিক বরিশালের উপ-মহাব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম বলেন, বিসিকের বেঙ্গল বিস্কুট কারখানার উৎপাদনে অনেক জ্বালানির দরকার হয়। গ্যাস থাকলে উৎপাদন খরচ কমে আসতো। বেঙ্গল বিস্কুটের বৃহদাকারে উৎপাদন প্লান্ট। এজন্য গ্যাস ছাড়া উৎপাদনে তাদের টিকে থাকাটাই চ্যালেঞ্জ হয়ে গেছে।
"যেসমস্ত উদ্যোক্তা পোশাক কারখানা করার জন্য মুনাফা খাটিয়েছেন, তারা গ্যাস না থাকায় এখনি উৎপাদনে যাচ্ছেন না। আমি বিশ্বাস করি, দ্রুতই বরিশালবাসী বিশেষ করে বরিশাল বিসিক গ্যাস পাবে। গ্যাস আসলে এই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে," যোগ করেন তিনি।
নজরুল ইসলাম আরও বলেন, "ফায়ার সার্ভিস করতে গেলে এক একরের বেশি জায়গা লাগে। সেই জায়গা বিসিকে নেই। যে কারণে বিসিক এলাকার মধ্যে আসলে আলাদা ফায়ার স্টেশন হওয়ার সুযোগ দেখছি না।"
তবে কোনো ঘটনা ঘটলে নিকটস্থ কাউনিয়া থানা পুলিশ তাৎক্ষণিক আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। যে কারণে বিসিকের ভেতরে পুলিশ ফাঁড়ির দরকার নেই বলেও মনে করেন বিসিক বরিশালের উপ-মহাব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম।
এই কর্মকর্তা বলেন, "বিসিকের উন্নয়নে ২০১৮ সালে ৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়। ওই টাকার বেশিরভাগ কাজই সম্পন্ন হয়েছে। চারপাশে দেওয়াল ও নিচু জমি ভরাটের কাজ প্রায় শেষ হয়। এখন শুধু ড্রেন ও কালভার্টের কাজ বাকি। এই কাজ শেষ হলে অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থান হবে। উদ্যোক্তাবান্ধব বিসিক গড়ে তুলতে সরকার কাজ করে যাচ্ছে।"
বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল বলেন, "বিসিকে শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বিসিক যেহেতু বরিশাল সিটি করপোরেশনের আওতায় অবস্থিত, তাই ওখানে চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপনের প্রধান দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। সিটি করপোরেশন স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নিলে আমরও সহায়তা করবো।"
এ বিষয়ে সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইজরাইল হোসেনের মুঠোফোনে একাধিকবার কল ও ক্ষুদেবার্তা পাঠানো হলেও তিনি কোনো জবাব দেননি।
বিদ্যুৎ উপ-কেন্দ্র নির্মাণের বিষয়ে বরিশাল ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি–২ এর প্রধান নির্বাহী প্রকৌশলী মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, "বিসিককে গুরুত্ব দিয়ে ওই এলাকার কাছেই আমরা ৪০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি উপ-কেন্দ্র স্থাপন করেছি। কিন্তু ওই উপ-কেন্দ্রে জনবল এখনো নিয়োগ না হওয়ায় চালু করা যাচ্ছে না। আশা করছি, আগামী দুই মাসের মধ্যে উপ-কেন্দ্রটি চালু করা যাবে।"
বরিশালের জেলা প্রশাসক শহীদুল ইসলাম বলেন, "আয়তনের দিক থেকে দেশের বড় শিল্পনগরী বরিশালে। অর্থনৈতিক দিক দিয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিসিককে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও শক্তিশালী করতে সর্বাত্মক সহায়তা করা হচ্ছে। বন্ধ থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ইতোমধ্যেই নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, যেসকল সমস্যা রয়েছে, সেগুলো নিরসনে আমরা সমন্বিতভাবে কাজ করছি।"
১৯৬১ সালে ১৩০ দশমিক ৬১ একর জমি নিয়ে বরিশাল বিসিক শিল্পনগরী গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়। ১৯৮৯ সালে প্রকল্পটি স্থানান্থর করা হয় রাজস্ব খাতে। পরবর্তীতে জমির পরিমাণ বৃদ্ধি করে ২৩০ একরে উন্নীত করে বরিশালে দেশের সবচেয়ে বড় বিসিক শিল্পনগরী গড়ে তোলার পরিকল্পনাও করা হয়।