বেড়েই চলেছে জমে থাকা স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) প্রায় আট মাস আগে জমে থাকা স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্সের জট কমানোর নিশ্চয়তা দিলেও এই কয়েক মাসে উল্টো আরো প্রায় চার লাখ ২৬ হাজার লাইসেন্স জমেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বিআরটিএ'র কাছে প্রায় আট লাখ ১৯ হাজার লাইসেন্স আবেদন জমে ছিল। বর্তমানে, জমে থাকা লাইসেন্সের সংখ্যা ১২ লাখ ৪৫ হাজারে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রায় তিন বছরের এই জট নিরসনে কর্তৃপক্ষ সচেষ্ট নয় বলে অভিযোগ করেন পরিবহন কর্মীদের অনেকে।
স্মার্ট লাইসেন্স দেওয়ার পরিবর্তে কর্তৃপক্ষ গাড়ি চালকদের দুই থেকে তিন মাস মেয়াদী সাময়িক অনুমোদনপত্র দিয়ে আসছে। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই এই অনুমোদনপত্রের সময়সীমা বাড়িয়ে নিতে হয়। বর্তমানে, এই প্রক্রিয়ায় অনুমোদন নেওয়া দেশের গাড়িচালক ও বাইকারদের জন্য চরম ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কাজের উদ্দেশ্যে মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার পরিকল্পনা শেখ পারভেজের। ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে তিনি বায়োমেট্রিকের মাধ্যমে স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদন জমা দেন। দুই বছর পেরিয়ে গেলেও মিলেনি লাইসেন্স। ফলে, দেশের বাইরে যেতে পারছেন না তিনি।
বিরক্ত ও হতাশ পারভেজ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমার স্মার্ট লাইসেন্স নেই। শুধুমাত্র এই কারণে আমি দেশের বাইরে যেতে পারছি না। ড্রাইভিং ভিসা পাওয়া সহজ নয়। অথচ এখন পর্যন্ত আমার দুটো সুযোগ হাতছাড়া হলো। এখনো বেকার আছি, তাই বেশ কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে।"
"বাবা-মাকে সুন্দর জীবন উপহার দিতে আমার বাইরে যাওয়ার স্বপ্ন বিআরটিএ'র জন্য ভাঙতে চলেছে," বলেন তিনি।
ভারতজুড়ে বাইক ভ্রমণে যেতে চেয়েছিলেন আরেক আবেদনকারী শামীম হোসেন। তিনি বলেন, "২০১৮ সালে বায়োমেট্রিকের মাধ্যমে আবেদন জমা দিই। কর্তৃপক্ষ কেবল দুই-তিন মাসের জন্য দেওয়া সাময়িক অনুমোদনের সময়সীমা বৃদ্ধি করে যাচ্ছে।"
"ভারত ভ্রমণের জন্য আমার আন্তর্জাতিক লাইসেন্স দরকার। সেজন্য আগে স্মার্ট লাইসেন্স প্রয়োজন। কিন্তু, বিআরটিএ তিন বছর ধরে আমাকে বসিয়ে রেখেছে।"
প্রতি দুই-তিন মাস পরপর বিআরটিএ অফিস থেকে সাময়িক অনুমোদন নেওয়া বিরক্তিকর ও সময়সাধ্য বলে জানান রফিকুল ইসলাম নামের একজন বাইকার।
"এই কাজ করতে অন্তত সারাদিন লেগে যায়। কিন্তু, তা সত্ত্বেও নিয়মিত আমাদের নবায়ন করতে হয়। তা না হলে, রাস্তায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর হাতে পড়ে আরেক ভোগান্তির ঝুঁকি আছে। প্রায়ই তারা অন্তত পাঁচ হাজার টাকা জরিমানাসহ মামলা ঠুকে দেয়," অভিযোগ করেন রফিকুল।
'সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি আমরা'
গত বছরের ডিসেম্বরে বিআরটিএ চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার জমে থাকা লাইসেন্স জট নিরসনের আশ্বাস দেন। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে জট কমতে শুরু করে একই বছরের ডিসেম্বর নাগাদ জমে থাকা স্মার্ট লাইসেন্স বিতরণ পুরোপুরি শেষ হওয়ার নিশ্চয়তা দেন তিনি।
বিআরটিএ কর্মকর্তারা জানান, তারা জমে থাকা কাজ যত দ্রুত সম্ভব শেষ করার দৃঢ় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
বিষয়টি উল্লেখ করে বিআরটিএ পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী বলেন, "আমরা দ্রুত সকল সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি। লাইসেন্সের কাজ আর জমবে না, কেননা আমরা নতুন আবেদনকারীদের লাইসেন্স প্রদান শুরু করেছি।"
লাইসেন্স তৈরি করার জন্য টাইগার আইটির সঙ্গে বিআরটিএ'র চুক্তি ছিল। কিন্তু, ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠানটি ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের কালো তালিকাভুক্ত হওয়ার পর কর্তৃপক্ষ বিকল্প প্রতিষ্ঠানের সন্ধান শুরু করে। প্রায় দেড় বছর অনুসন্ধানের পর ভারতীয় প্রতিষ্ঠান মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টারকে (এমএসপি) লাইসেন্স ছাপানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়।
২০১৯ সালে লাইসেন্স ছাপানোর দায়িত্ব পেয়ে এমএসপি বাংলাদেশে ছাপাখানা স্থাপন করে। চুক্তি অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির পাঁচ বছরে ৪০ লাখ স্মার্ট লাইসেন্স ছাপানোর পাশাপাশি ২০২১ সাল নাগাদ নয় লাখ লাইসেন্স সরবরাহের কথা ছিল।
কিন্তু, প্রায় নয় মাস পর এমএসপি মাত্র ১৩ হাজার কার্ড ছাপাতে সক্ষম হয়।
লাইসেন্সের পাহাড় জমায় বিআরটিএ'কে দায়ী করে জাতীয় সড়ক পরিবহন মটর শ্রমিক ফেডারেশনের বিপণন সম্পাদক মোহাম্মদ জামিরুল হক বলেন, "সম্ভবত কোনো কারণবশত কর্তৃপক্ষ সময়মতো স্মার্ট লাইসেন্স প্রদানের জন্য এমএসপিকে চাপ দিতে পারছে না।"
"আর তাই, এই কাজে এত সময় লাগছে," বলেন তিনি।
এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বিআরটিএ পরিচালক মাহবুব-ই-রব্বানি বলেন, "যেকোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য নতুন পরিবেশে ব্যবস্থাপনা দাঁড় করাতে সময়ের প্রয়োজন। মহামারির কারণে এমএসপি সময়মতো কাজ করতে পারেনি।"
"কোভিড-১৯ মহামারির কারণে ফ্লাইট বাতিল হওয়ায় জার্মানি ও ইতালিতে তাদের কিছু চালান আটকে যায়। কিন্তু, এখন সেই সমস্যার সমাধান হয়েছে। এমএসপি এখন পুরোদমে কাজ করতে প্রস্তুত," বলেন তিনি।
বিআরটিএ এক মাসের ভেতর জমে থাকা লাইসেন্স বিতরণ শুরু করবে বলে জানান তিনি। একইসঙ্গে, তিনি আগামী ছয় মাসের ভেতর বর্তমান লাইসেন্স জট নিরসনের আশাবাদ ব্যক্ত করেন।