ব্রাহ্মণবাড়িয়া পাদুকা শ্রমিকদের কাছে প্রযুক্তি এখন অভিশাপ
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সম্ভাবনাময় পাদুকা শিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে জুতার কাজ শিখেছিলেন দ্বীন মোহাম্মদ। প্রায় তিন দশক ধরে এ শিল্পের ওপর ভর করেই চলছে তার সংসার। কিন্তু পাদুকা শিল্পের যে সুদিন দেখে তিনি এ পেশায় এসেছিলেন, তা এখন তার কাছে সোনালী অতীত। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের পীরবাড়ি এলাকার ‘দিশা সুজ’ নামে একটি জুতা তৈরির কারখানায় সোল্ডম্যান (জুতার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সকল কাজ) হিসেবে কাজ করছেন তিনি। প্রযুক্তির চাপে দিন-দিন হাতে তৈরি জুতার চাহিদা কমতে থাকায় অনেক শ্রমিকই এখন বেকার হওয়ার ভয়ে পেশা বদলের পথে রয়েছেন।
পাদুকা শিল্প সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলা জানা গেছে, ১৯৬৩ সালে ভারতের পাটনা থেকে আসা মাহমুদ আলী নামে এক ব্যবসায়ী সর্বপ্রথম ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে কুমারশীল মোড় এলাকায় একটি পাদুকা বা জুতা তৈরির কারখানা স্থাপন করেন। এরপর লাভজনক ব্যবসা হওয়ায় ধীরে ধীরে জেলার বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠতে থাকে জুতা তৈরির কারখানা। কয়েক হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয় কারখানাগুলোতে।
বর্তমানে জেলা শহরের পীরবাড়ি, নাটাই, ভাটপাড়া ও রাজঘরসহ কয়েকটি এলাকায় শতাধিক কারখানা সচল রয়েছে। গুণগত মান বজায় রেখে তুলনামূলক কম দামে জুতা তৈরি করায় দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা এসে নিয়ে যান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জুতা। প্রতি জোড়া জুতা পাইকারদের কাছে বিক্রি হয় ১৮০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত। আর প্রতি ডজন জুতা তৈরি করে একজন শ্রমিক ১৬০ টাকা মজুরি পান। একজন শ্রমিক গড়ে প্রতিদিন পাঁচ-ছয় ডজন জুতা তৈরি করতে পারেন। কিন্তু এখন চাহিদা কমে যাওয়ায় একজন শ্রমিক দিনে সর্বোচ্চ দুই থেকে তিন ডজন জুতা তৈরি করতে পারেন। বাজারে এখন ভারতীয় ও চায়না জুতার চাহিদাই বেশি বলে জানিয়েছেন কারখানা মালিকরা। এর ফলে বাজারে টিকে থাকার জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কয়েকটি কারখানায় এখন মেশিনে জুতা তৈরি হচ্ছে।
এদিকে, মেশিনে জুতা তৈরিতে খরচ কম হওয়ায় দিন দিন কমছে শ্রমিকের চাহিদা। গত কয়েক বছর ধরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অ্যাক্টিভ ফুটওয়্যার, ফাইভ স্টার ফুটও্যয়ার, সেভেন স্টার ফুটওয়্যার ও এয়ার ফুটওয়্যার নামে চারটি কারখানা মেশিনের মাধ্যমে জুতা তৈরি করছে। এ কারখানাগুলোতে উৎপাদন খরচও কম বলে জানিয়েছেন মালিকরা। আরও বেশ কয়েকটি কারখানায় মেশিন স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে বলে জানা গেছে।
ভারত ও চায়না জুতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাজারে টিকে থাকতে চাহিদা অনুযায়ী মেশিনে জুতা তৈরির ফলে হাতে তৈরি অনেক জুতার কারখানা এখন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। আগে যেখানে দেড়শ’ শ্রমিক কাজ করেও কুলাতে পারতেন না, সেখানে এখন ৩০/৩৫ জন শ্রমিক রাখতেই বেগ পোহাতে হচ্ছে মালিকদের। এর ফলে অনেক শ্রমিক এখন বিকল্প পেশা খুঁজছেন।
সোল্ডম্যান দ্বীন মোহাম্মদ বলেন, ‘‘পাদুকা শিল্পের চাহিদা দেখে আমি ১৯৯০ সালে শহরের মধ্যপাড়া এলাকার ‘ডিলাক্স সুজ’ নামে একটি কারখানায় সোল্ডম্যানের সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করি। নিজের টাকা খরচ করে কাজ শিখতে হয়েছে। তিনবছর কাজ শিখে ঢাকা ও চট্টগ্রামের কয়েকটি কারখানায় কাজ করেছি। এ কাজ করেই আমার সংসার চলে। আমি যখন এ কাজে ঢুকেছিলাম তখন অনেক চাহিদা ছিল। কিন্তু এখন সেই চাহিদা দিন-দিন কমছে। হাতের তুলনায় মেশিনে বেশি জুতা তৈরি করা যায়। অনেক শ্রমিক কর্মহীন হয়ে এ কাজ ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে আমাকেও অন্য একটা উপার্জনের পথ বেছে নিতে হবে।’’
শিবু ঋষি নামে এক শ্রমিক বলেন, ‘‘মেশিনে জুতা তৈরি শুরু হওয়ার পর থেকেই আমাদের শ্রমিকদের চাহিদা কমে গেছে। আমাদের কারখানায় আমরা আগে দেড়শ’ শ্রমিক কাজ করতাম, এখন মাত্র ৩০/৪০ জন আছি। অনেকেই জুতার কাজ ছেড়ে রিকশা চালাচ্ছে, কেউ রাজমিস্ত্রি কেউ ইটখোলায় কাজ নিয়েছে।’’
মো. সোহেল নামে আরেক শ্রমিক বলেন, ‘‘আমি ২০ বছর ধরে জুতা তৈরির কাজ করছি। এ কাজ করেই আমার সংসার চলে। গত দেড় বছর ধরে হাতে তৈরি জুতার চাহিদা কমেছে। আগে রাত-দিন মিলিয়ে কাজ করেছি। এখন আর আগের মতো কাজের চাপ নেই। এমন অবস্থা আগে কখনও দেখিনি।’’
দিশা সুজের মালিক মো. নাদিম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ‘‘দুই-তিন বছর হলো বাজারে ভারতীয় ও চায়না জুতা এসেছে। এর আগেও যখন বাজার খারাপ হয়েছে তখন কেউ অটোরিকশা চালিয়েছে, কেউ অন্য কাজ করেছে। এখন আমাদের প্রতিযোগিতা করতে হয় ভারত-চায়নার পণ্যের সঙ্গে। হাতে তৈরি জুতা দিয়ে তো তাদেরকে আটকাতে পারছি না। গত রমজানের পর থেকে লোকসান দিতে দিতে কারখানা চালিয়ে যাচ্ছি। আর এক বছর পর হয়তো কারখানা নাও চালাতে পারি।’’
অ্যাক্টিভ ফুটওয়্যারের মালিক রাকিবুর রহমান জানান, হাতে তৈরি জুতার জন্য শ্রমিক বেশি লাগে। এখন মেশিন আসার কারণে শ্রমিক কিছুটা কম লাগে। এতে করে আমাদের খরচের পরিধিও কমেছে। হাতের তুলনায় মেশিনে উৎপাদন আরও বেশি হয়। আমাদের ব্যবসা মূলত রমজান মাসে। এখন ব্যবসা কিছুটা কম।
তবে প্রযুক্তির কারণে শ্রমিকদের চাহিদা কমে যাওয়ার বিষয়টি সঠিক নয় দাবি করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পাদুকা শিল্প মালিক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হানিফ মিয়া বলেন, মেশিনে শুধুমাত্র সোল্ড তৈরি করা হয়। বাকি সবকিছুই হাতের কাজ। তবে চাহিদা অনুযায়ী জুতা তৈরি করতে না পারায় হাতে তৈরি জুতার কারখানাগুলোর কিছুটা অসুবিধা হচ্ছে।