ভারতীয় ঋণের জটিল শর্তে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে একাধিক হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্প
বাস্তবায়ন শুরুর পাঁচ বছরেও জামালপুরে শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং নার্সিং কলেজ স্থাপন প্রকল্পে ভারতের প্রতিশ্রুত ঋণের অর্থছাড় হয়নি । গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণ কাজ আটকে থাকায় প্রকল্পটি থমকে আছে।
ভারতীয় ঋণের জটিল শর্ত এবং দরপত্র সংক্রান্ত দলিলে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সম্মতি আদায়ে বিলম্ব হওয়ার কারণে প্রকল্পটিতে এ পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় এ প্রকল্পটিতে ভারতীয় ঋণ ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
এ প্রকল্পে দ্বিতীয় লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) আওতায় ৩৫.৮৯ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়ার কথা ছিল ভারতের।
এছাড়া যশোর, কক্সবাজার, পাবনা, নোয়াখালীতে ৫০০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্পও ভারতীয় ঋণ ব্যবহার না করার সিন্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। আড়াই বছর ধরে বাস্তবায়নাধীন এ প্রকল্পের নির্মাণ কাজ এখনও শুরু করা যায়নি। চলমান প্রকল্পটিতে ভারতের ১৮০ মিলিয়ন ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতি রয়েছে।
স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব হেলাল উদ্দিন টিবিএসকে জানান, এলওসি ঋণের শর্তের কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে সমস্যা হয়। ভারতীয় এলওসি ঋণের শর্ত অনুযায়ী নির্মাণ কাজে ইট-বালু সিমেন্টসহ ভারত থেকে আনতে হয়। এছাড়া দরপত্র সংক্রান্ত দলিলে বারবার ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সম্মতি নিতে হয়। এছাড়া স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অবকাঠামোর এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে ডাক্তাররা। প্রকল্প পরিচালকও ডাক্তার। যারা উন্নয়ন সহযোগীদের কঠিন শর্ত মেনে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারে না। এসব জটিলতায় এলওসি ঋণের আওতায় বাস্তবায়ন না করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে এ সিদ্ধান্ত অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে (ইআরডি) জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, দুই বিনিয়ন ডলারের দ্বিতীয় এলওসির আওতায় ১৫টি এবং ৪.৫ বিলিয়ন ডলারের তৃতীয় এলওসির আওতায় ১৬ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য চূড়ান্ত তালিকা করা হয়। তিন –চার বছরেও কিছু মন্ত্রণালয় প্রকল্প প্রস্তাব প্রণয়ন করতে পারেনি, বা বাস্তবে ভারতীয় ঋণের শর্ত মেনে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারছে না। এ ধরণের প্রকল্পগুলো চিহ্নিত করা হচ্ছে। একই সঙ্গে প্রকল্পগুলো এলওসি ঋণে বাস্তবায়ন করবে কিনা, সে বিষয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মতামত চাওয়া হয়েছে। সবগুলো মন্ত্রণালয় থেকে চূড়ান্ত সিন্ধান্ত পাওয়া গেলেই এ বিষয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেওয়া হবে।
ভারতীয় ৭.৩৬ বিলিয়ন ডলারের তিনটি এলওসি চুক্তি রয়েছে বাংলাদেশের। ভারতের সঙ্গে ৮৬০ মিলিয়ন ডলারের প্রথম এলওসি ঋণের চুক্তি সই হয় ২০১০ সালের ৭ আগষ্ট। দ্বিতীয় এলওসি ঋণের চুক্তি সই হয় ২০১৬ সালের ৯ মার্চ। এবং তৃতীয় এলওসি চুক্তি হয় ২০১৭ সালের ৪ অক্টোবর।
প্রত্যেক চুক্তির শর্ত একই রকম। শর্ত অনুযায়ী, প্রকল্পের পণ্য ও ইট, বালি, সিমেন্টসহ নির্মাণ সামগ্রীর ৭৫ শতাংশই ভারত থেকে আনতে হয়। তবে ক্ষেত্রবিশেষে বাস্তবায়ন পর্যায়ে প্রকল্প কর্তৃপক্ষের আবেদন করলে, অবকাঠামো প্রকল্পে কিছুটা ছাড় দিচ্ছে ভারত। এ ক্ষেত্রে শর্ত শিথিল করে ৭৫ শতাংশের পরিবর্তে ৬৫ শতাংশ করা হয়।
এছাড়া প্রকল্পে দরপত্রে ও ভারতীয় ঠিকাদার ছাড়া অন্য কোনো দেশের ঠিকাদার অংশ নিতে পারে না। দরপত্র দলিল তৈরি থেকে নিয়োগ পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সম্মতি নেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ স্থাপন প্রকল্পের অগ্রগতি
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি অনুয়ায়ী জামালপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নির্মাণের কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালের জুনে।
সরকারি ও ভারতীয় অর্থায়নে মোট ৯৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্পের সরকারি অর্থায়নে বিভিন্ন ভবন নির্মাণ হলেও হাসপাতাল ভবন, ভারতীয় ঋণে নির্মাণের প্রস্তাব ছিল। এছাড়া ভারতীয় ঋণের আওতায় হাসপাতালের বিভিন্ন যন্ত্রপাতিও কেনার কথা ছিল।
এ প্রকল্পের বিষয়ে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পটির নির্মাণ ও ক্রয় কাজে ৫১টি প্যাকেজে ভাগ করে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। এর মধ্যে মূল হাসপাতাল ভবন নির্মাণসহ যন্ত্রপাতি কেনার কাজ ভারতীয় ঋণের বাস্তবায়ন করার কথা ছিল। সরকারি অর্থায়নে যেসব ভবন নির্মাণ হচ্ছে, তার কাজ ইতোমধ্যে অনেক এগিয়ে গেলেও ভারতীয় অর্থায়নের কাজ এখনও শুরুই করা সম্ভব হয়নি।
এতে আরও বলা হয়েছে, ভারতীয় ঋণের শর্ত অনুযায়ী, ভারতীয় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ করার জন্য যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়। এতে দরপত্র আহ্বানের আগে বিভিন্ন পর্যায়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের অনুরোধে দরপত্র দলিল পাঁচবার সংশোধন করতে হয়েছে।
আর এ কারণে প্রকল্পে মেয়াদ আড়াই বছর বাড়িয়েও কাজ শেষ করা সম্ভব হয়নি বলে জানান আইএমইডি।
প্রকল্পটি ২০১৯ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল। পরে প্রকল্পের মেয়াদ আরও আড়াই বছর অর্থাৎ ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। অতিরিক্ত মেয়াদেও প্রকল্পের ৮০% কাজ বাকী রয়ে গেছে। এ অবস্থায় প্রকল্পটির মেয়াদ আবারও বাড়ানোর প্রস্তুতি দিচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
চার জেলায় মেডিকেল কলেজ নির্মাণ
এ দিকে যশোর, কক্সবাজার, পাবনা ও নোয়াখালী মেডিকেল কলেজে ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল ও আনুষঙ্গিক ভবন স্থাপনের প্রকল্পটি ২০১৮ সালের মে মাসে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় অনুমোদন পায়। চলতি বছরে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ছিল।
আড়াই বছরেও এ প্রকল্পে বেতন-ভাতা ছাড়া কোনো অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হয়নি বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, দরপত্রে অনুমোদনের জটিল প্রক্রিয়ার কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি।
মেডিকেল পর্যায়ে উচ্চ শিক্ষা নিশ্চিত করতে এবং জেলা পর্যায়ে উন্নত মানের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে ২১০৩ কোটি ব্যয়ে প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল। এ প্রকল্পে ভারতীয় ঋণ রয়েছে ১৮০ মিলিয়ন বা ১৪৪০ কোটি টাকা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, দেশের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং জেলা হাসপাতালগুলো যথাক্রমে প্রাথমিক ও সেকেন্ডারি স্বাস্থ্য সেবা দিয়ে থাকে। সরকারিভাবে টারশিয়ারি স্বাস্থ্য সেবামূলক কার্যক্রম সাধারণত জাতীয় ও বিভাগীয় পর্যায়ে মেডিকেল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পরিচালিত হয়ে থাকে।
টারশিয়ারি পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ দিকটি বিবেচনায় এনে টারশিয়ারি খাতে স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নের জন্য দেশের চারটি গুরুত্বপূর্ণ জেলায় চারটি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞ মতামত
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক মুজাহেরুল হক বলেন, "হাসপাতাল এবং মেডিকেল কলেজ নির্মাণের এসব প্রকল্প সময়মতো শেষ করা হলে, কোভিড পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য সেবা আরও জোরদার হত। মানুষ উপকৃত হত। এখন প্রকল্পগুলো কেন নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে না, তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের আরও দায়বদ্ধ হতে হবে। প্রয়োজনে দক্ষ জনবল নিয়োগ করে দ্রুত প্রকল্পগুলো শেষ করা উচিত"।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) একজন উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন বলেন, "স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে অবশ্যই হাসপাতাল প্রয়োজন। চলমান মেয়াদোত্তীর্ণ যেসব প্রকল্প রয়েছে, সেগুলো সময়মত শেষ হলে অবশ্যই উপকার পাওয়া যেত। আইসিইউ বেড বাড়ত। অন্যান্য রোগের চিকিৎসা দেওয়া যেত"।
তবে আরও বেশি হাসপাতাল থাকলেই কোভিড পরিস্থিতি মোকাবিলা সহজ হতো, তা ঠিক না। যদি সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, যতই হাসপাতালই নির্মাণ হোক পরিস্থিতি অনুকূলে আসবে না। এ জন্য কোভিডের এ পরিস্থিতিতে জনগণ যেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে সেখানে জোর বেশি দিতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি সংক্রান্ত প্রচার কাজে সারা দেশে স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ দিতে হবে । আক্রান্ত হয়ে যাতে কাউকে হাসপাতাল বা আইসিইউ পর্যন্ত যেতে না হয়, সে ব্যবস্থা আগে নিতে হবে।