ভালোবেসে ফিলিপাইন থেকে ময়মনসিংহের গ্রামে আসা পেট্রিয়াকার বাজিমাত ভোটে
ফিলিপাইনের মিন্দানাও স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ফিসারিজ বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন জীন ক্যাটামিন পেট্রিয়াকা। গ্র্যাজুয়েশন শেষে চাকরি নেন সিঙ্গাপুরের একটি কোম্পানিতে। সেখানেই পরিচয় হয় বাংলাদেশের ময়মনসিংহের যুবক জুলহাসের সাথে।
পরিচয় থেকে প্রেম, প্রেম থেকে পরিণয়- জুলহাসকে বিয়ে করেন। পরে নিজের ধর্ম, দেশ আর স্বজনদের ছেড়ে পেট্রিয়াকা থিতু হন বাংলাদেশেই।
ঠিকমতো বাংলা না বলতে পারা ভিনদেশি এই পেট্রিয়াকা ভালোবেসে সবার মন জয় করেছিলেন, যার প্রতিদান তাকে দিয়েছে এলাকাবাসী, করেছে জনপ্রতিনিধি।
গত ১১ নভেম্বর দ্বিতীয় দফা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সংরক্ষিত মহিলা আসনে সদস্য পদে প্রার্থী হয়েই করেছেন বাজিমাত। 'মাইক' প্রতীক নিয়ে তিনি পেয়েছেন ৪ হাজার ৪৯৬ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী পেয়েছেন ১ হাজার ৮৩৭ ভোট। অর্থাৎ প্রতিপক্ষকে দ্বিগুণেরও বেশি ভোটে হারিয়েছেন তিনি।
পেট্রিয়াকা জানান, গ্র্যাজুয়েশনের পর সিঙ্গাপুরে চাকরি করতে যান। একই সময় ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার রাধাকানাই এলাকার তরুণ জুলহাস উদ্দিন শ্রমিক হিসেবে 'লেবার ভিসা' নিয়ে সিঙ্গাপুর যান। 'সান হাফ সিং' নামক কোম্পানিতে চাকরিসূত্রে পরিচয় হয় জুলহাস আর পেট্রিয়াকার; পেট্রিয়াকা ছিলেন ঐ কোম্পানির একজন নির্বাহী কর্মকর্তা।
২০০৮ সালে পরিচয়ের পর ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে উঠতে থাকে। শেষপর্যন্ত পরিবারকে বুঝিয়ে ২০১১ সালে বাংলাদেশে জুলহাসের কাছে চলে আসেন পেট্রিয়াকা। সংসার পাতেন ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার রাধাকানাই ইউনিয়নের দবরদস্তা গ্রামে। বিয়ের পর ধর্মান্তরিত হয়ে জীন ক্যাটামিন পেট্রিয়াকা থেকে নাম বদলে হয়ে যান জেসমিন আক্তার জুলহাস।
তবে কাগজ-কলমের ঝামেলা এড়াতে প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় থেকে গেছে আগের নামেই।
ভোটের অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাইলে পেট্রিয়াকা বলেন, "আমি অনেক কষ্ট করেছি। আমার ঘরের চালে অজস্র ছিদ্র। রীতিমতো আকাশ দেখা যায়। নির্বাচনে খরচ করার মতো টাকাও আমার ছিলো না।
আমি ভোটের জন্য কাউকে টাকা দেইনি। সবাইকে ভালোবেসেছি শুধু, আজ তারই প্রতিদান পেয়েছি।"
কথা বলার একপর্যায়ে কেঁদে ফেলেন পেট্রিয়াকা। তিনি বলেন, "আমি ভালো বাংলা বলতে পারি না। তাই গ্রামবাসীর প্রতি আমার যে অনুভূতি তা ঠিকমতো প্রকাশ করতে পারছি না। তবে আমার চোখের পানি দেখেই সবাই বুঝেছে, আমি কতোটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছি।"
পেট্রিয়াকা বলেন, "আমি লেখাপড়ার গুরুত্ব বুঝি। এখানে এসে আমি দেখেছি, গ্রামের শিশুরা পড়াশোনার পরিবেশ ও সুযোগ পায় না। তাদের জন্য আমি কিছু করতে চাই।"
গ্রামের রাস্তাঘাটের শোচনীয় অবস্থা জানিয়ে তিনি বলেন, "আমার এলাকার কৃষকেরা খুব কষ্ট করে তাদের ফসল বাজার পর্যন্ত নিয়ে যায়। তাদের ভোগান্তির শেষ নেই। আমার একার পক্ষে হয়তো এ সকল সমস্যা সমাধান করা সম্ভব না। তবে আমি সরকারের কাছে তাদের হয়ে দাবি জানাতে পারব।"
পেট্রিয়াকা জানান, নির্বাচনে দাঁড়ানোর কোনো পরিকল্পনা ছিল না তার। বরং এলাকার মানুষের কথাতেই তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন।
জীন ক্যাটামিন পেট্রিয়াকার স্বামী জুলহাস উদ্দিন স্থানীয় রাধাকানাই বাজারে ওয়ার্কশপের ব্যবসা করেন এখন।
জুলহাস বলেন, তার স্ত্রী চাইলেই বড় গবেষক হতে পারতেন। কিন্তু সে পথে না গিয়ে তিনি বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধি হিসেবে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
"আমার প্রতি তার ভালোবাসার প্রতিদানই যেন এবার এলাকাবাসী ব্যালট পেপারের মাধ্যমে দিলো।"
জুলহাসের মা এবং পেট্রিয়াকার শাশুড়ি রহিমা খাতুন বলেন, "পেট্রিয়াকা বাংলা জানে না। আমি নিজেও সব সময় তার সব কথা বুঝতে পারি না। এলাকার মানুষদেরও তার কথা বুঝতে কষ্ট হয়। তবে সে কখনো মিথ্যা বলে না, কারো ক্ষতি করে না। মানুষের বিপদে-আপদে ছুটে যায়। এজন্যই গ্রামের মানুষ তাকে পছন্দ করে।"
ফুলবাড়িয়া উপজেলার রাধাকানাই ইউনিয়নের ১, ২ ও ৩ নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত মহিলা আসনে পেট্রিয়াকা জয়ী হওয়ায় এলাকায় বইছে আনন্দের বন্যা। অনেকেই পেট্রিয়াকার বাড়িতে এসে শুভেচ্ছা বিনিময়ের পাশাপাশি করেছেন আনন্দ মিছিল।
এমনই একজন আসমা আক্তার বলেন, "যে বাংলাদেশের মানুষকে ভালোবেসে নিজের দেশ ছেড়ে চলে এসেছে, তাকে বিশ্বাস না করে কীভাবে থাকবো!"
কৃষক শফিকুল ইসলাম বলেন, "দেশের অনেক নেতাকেই তো ভোট দিয়েছি, কোনো লাভ হয়নি। এবার বিদেশি একজনকে দিলাম। দেখি ভাগ্যের পরিবর্তন হয় কিনা।"