মহামারির ধকল কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে মুদ্রণশিল্প
দেশের অন্যান্য জেলা শহরগুলোর মতো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুদ্রণশিল্পও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে করোনার কারণে। তবে আশার কথা হলো- মহামারির ধকল কাটিয়ে আবারও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে মুদ্রণশিল্প। এখন স্বাভাবিক সময়ের মতোই চলছে ছাপাখানার বাণিজ্যিক কার্যক্রম। মূলত ওয়াজ-মাহফিল ও পৌরসভা নির্বাচনী প্রচারণার ব্যানার, পোস্টার ও লিফলেট ছাপিয়ে করোনাকালীন ক্ষতি কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করছেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা।
দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে ছাপাখানাগুলো। স্কুল-কলেজ না খুললেও নির্বাচনী পোস্টার ও সাধারণ কিছু ছোট ছোট কাজ ব্যবসায়ীদের মুখে হাসি ফোটাচ্ছে।
বগুড়ার ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে এই ব্যবসা স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। তবে ময়মনসিংহের ছাপাখানাগুলো এখনো ধুঁকছে। এখানকার বিখ্যাত প্রিন্টিং প্রেসের স্বত্বাধিকারী আলী ইউসুফ জানান, তিনি আশা করেছিলেন নতুন বছরের শুরুতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন কাজ পাবেন। ফেব্রুয়ারির বই মেলা উপলক্ষে প্রতিবছর বই ছাপার ভালো কাজও থাকে কিন্তু এবার তাও পাওয়া যায়নি।
ময়মনসিংহ অঞ্চলের আরেক মুদ্রণ শিল্প প্রতিষ্ঠান কোরাইশী প্রেসের স্বত্বাধিকারী ইয়াজদানি কোরাইশী জানান, প্রতি বছর নির্বাচনকালীন সময়ে একটি ভালো উপার্জন হয়। এবারও ছাপার কাজ হচ্ছে, তবে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক না হওয়ায় পোস্টার ছাপার সংখ্যা কমেছে। আগে যেখানে একজন প্রার্থী লাখের উপরে পোস্টার ছাপাতো, এবার ২০ থেকে ২৫ হাজারের বেশি ছাপেনি। তাই যা আশা করেছি হয়নি।
ময়মনসিংহ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাধারন সম্পাদক ইউসুফ খান পাঠানও একই কথা জানান, তার সংগঠনে ৭০ টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। নির্বাচনের পাশাপাশি বছরের প্রথমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাজ যেমন ডায়েরি, ক্যালেন্ডার, খাতাসহ নানা উপকরনের কাজ থাকে; সাথে বই ছাপানোর কাজ। এখন এসব নেই। নির্বাচনের পোস্টার ছাপা হচ্ছে। তবে গত বছরের চেয়ে কম। গত নির্বাচনে তিনি একাই পোস্টার ছেপেছেন ১৫ লক্ষ টাকার। অথচ এবার ছেপেছেন তিন লাখ টাকার মাত্র।
তারপরও ছাপাখানাগুলো আবার ব্যস্ত হওয়াকে ব্যবসায়ীরা শুভ লক্ষণ মনে করছেন। তারা মনে করেন পরিস্থিতি যত দিন যাবে আরও স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
যেমন বগুড়া আর ব্রাহ্মণবাড়িয়া ব্যবসায়ীরা এখুনি মুদ্রণ ব্যবসা ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে বলে মত দিয়েছেন। বগুড়া মুদ্রণের দিক থেকে উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে বড় বাজার। এখন রাজশাহী, রংপুর ও দিনাজপুরেও মুদ্রণ শিল্পের বিকাশ ঘটেছে, কিন্তু বগুড়ার অবস্থান এখনও দৃঢ়। জানা যায় ১৯৩০ সালের দিকে বগুড়ায় দু-একটি ছাপাখানা দিয়ে মুদ্রণ শিল্পের শুরু। বগুড়ার প্রেসের সংখ্যা এখন প্রায় পাঁচ শতাধিক। যদিও বগুড়া মুদ্রণ শিল্প সমিতির হিসাবে এই সংখ্যা ১৯০। তবে এই ১৯০ জনের মধ্যে অনেকের একাধিক প্রেস রয়েছে।
বগুড়া শহরের এক নম্বর রেলঘুমটি এলাকায় অবস্থিত তৃপ্তি প্রেসের মালিক মাছুদুর রহমান হেলাল বলেন, ছাপাখানার বাজার এখন স্বাভাবিক না হলেও গতি পেয়েছে গত চারমাস ধরে। ভোট সেই গতিকে আরও জোরদার করেছে। বর্তমানে যে সংকট রয়েছে তা হলো স্কুল কলেজ বন্ধ থাকার ফল। আগামীতে স্কুল কলেজ খুললে সেই পরিস্থিতিও পুরো ঠিক হয়ে যাবে।
শহরের প্রেসপট্টিতে অবস্থিত মাশরেকী প্রেসের মালিক শাহীদুর রহমান বিপ্লব বলেন, বগুড়ার লকডাউন গত ডিসেম্বরে তুলে নেওয়ার পর আমাদের ব্যবসা ৭০ শতাংশ বেড়েছে। এখন কর্মচারীদের বেতনে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। ব্যবসায়িকভাবে কাজের ধরন আগের অবস্থানে না গেলেও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। করোনার মধ্যে চোখে অন্ধকার দেখার পর্যায় থেকে এখন আমরা সরে এসেছি। দু'চারমাসের মধ্যে এই পরিস্থিতি আরও ভালো হবে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা মুদ্রণশিল্প মালিক সমিতির দেয়া তথ্যমতে, জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে ৩০টির মতো ছাপাখানা রয়েছে। রাজনৈতিক দল ও নেতাকর্মীদের ব্যানার, পোস্টার, লিফলেট, বিভিন্ন ব্যবসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং হাসপাতালের দাপ্তরিক কাগজপত্রসহ চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্র, ভিজিটিং কার্ডসহ অন্যান্য কাগজপত্র ছাপার উপরই নির্ভরশীল এ ছাপাখানাগুলো। কয়েকশ শ্রমিক কাজ করে ছাপাখানাগুলোয়।
মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে এই শিল্পে প্রায় ২ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুদ্রণশিল্প মালিক সমিতি কর্তৃপক্ষ। মহামারির সংক্রমণ রোধে গত বছরের ২৬ মার্চ থেকে জেলার সব ছাপাখানা বন্ধ করে দেয়া হয়। দুই মাস বন্ধ রাখার পর ছাপাখানাগুলো আবার খুললেও ব্যবসা কমে যায় ৮০ শতাংশ।
এতে করে অর্ধেকেরও বেশি শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েন। অধিকাংশ ছাপাখানার মেশিন বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ব্যবসা না হলেও অন্যান্য জেলার ছাপাখানার মালিকদের মতো এখানকার প্রেসমালিকদেরও স্থায়ী শ্রমিকদের বেতন-ভাতা, দোকান ভাড়া ও বৈদ্যুতিক বিলসহ আনুষাঙ্গিক সকল খরচই মেটাতে হয়েছে । তবে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসার পর গত ডিসেম্বর মাস থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছাপাখানাগুলো্ও আবার কর্মচঞ্চল হয়ে উঠেছে।
স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকলেও ওয়াজ-মাহফিল এবং নির্বাচনী প্রচারণার ব্যানার, পোস্টার ও লিফলেট ছাপানোর কাজ হচ্ছে ছাপাখানাগুলোতে। যদিও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, আগে নির্বাচনী কাজের মধ্যে কাউন্সিলর প্রার্থীদের কাজই ছিল বেশি। একেকজন কাউন্সিলর প্রার্থী দেড়-দুই লাখ টাকার ব্যানার, পোস্টার ও লিফলেট ছাপাতেন। কিন্তু এখন ৩০-৪০ হাজার টাকার ছাপাচ্ছেন। এতে করে নির্বাচনী প্রচারণাকেন্দ্রিক ছাপার কাজ সংকুচিত হয়ে পড়েছে।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এখন ওয়াজ-মাহফিল ও নির্বাচনের কাজ হচ্ছে বেশি। টুকটাক অনুষ্ঠানের দাওয়াত কার্ড ও ভিজিটিং কার্ড ছাপার কাজও হচ্ছে। করোনার প্রাদুর্ভাব শুরুর আগে প্রতিটি ছাপাখানায় গড়ে প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকার কাজ হতো। এখন প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকার কাজ হচ্ছে। তারপরও কাজ বেশি হওয়ায় শ্রমিকদের এখন রাত-দিন মিলিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। ব্যবসা আরও ভালো হলে করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের তিতাস অফসেট প্রেসের মেশিন অপারেটর মো. ইয়াছিন জানান, ১৫ হাজার টাকা বেতনে তিনি কাজ করেন। করোনাকালে কোনো কাজই ছিলনা। বেশিরভাগ সময়ই ছাপাখানা বন্ধ ছিল। তখন পরিবার নিয়ে চলতে খুব কষ্ট হয়েছে। তবে এখন আগের মতোই কাজ হচ্ছে।
তিতাস অফসেট প্রেসের স্বত্বাধিকারী মো. গিয়াস উদ্দিন বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে আমার ছাপাখানায় ৪-৫ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। কোনো কাজ করতে পারিনি, দুই মাস ছাপাখানা বন্ধ রাখতে হয়েছে। কিন্তু ভাড়া ও বিদ্যুৎবিলসহ সকল খরচই আমাদের মেটাতে হয়েছে। করোনার প্রাদুর্ভাব শুরুর আগে দৈনিক ৮-১০ হাজার টাকার কাজ হতো। এখন আমার এখানে প্রতিদিন ১৫-২০ হাজার টাকার কাজ হচ্ছে'।
ছাপাখানায় কাজ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান পুলক গ্রাফিক্সের স্বত্বাধিকারী বাছির দুলাল জানান, করোনার আগে তিনি প্রতি মাসে গড়ে ৫০ হাজার টাকার কাজ সরবরাহ করতেন। করোনাকালে কাজ একেবারে বন্ধ ছিল। মাস দুয়েক ধরে আবারও কাজ আসছে। এখন গড়ে ২০-২৫ হাজার টাকার কাজ সরবরাহ করতে পারছেন বলে জানান তিনি।
মৌসুমি অফসেট প্রেসের স্বত্বাধিকারী খায়রুজ্জামান ইমরান বলেন, 'করোনাকালে ব্যবসা না হলেও ছাপাখানার স্থায়ী শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে হয়েছে। এখন ব্যবসা কিছুটা ভালো। প্রতিদিন ১৫-২০ হাজার টাকার কাজ হচ্ছে। ব্যবসা চালু থাকলে আমাদের ক্ষতি কাটিয়ে উঠা সম্ভব হবে'।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা মুদ্রণশিল্প মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শামছুল আলম বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে আমাদের শিল্পে ২ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে। আমাদের ব্যবসা ৮০ শতাংশ কমে গিয়েছিল। কারণ রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ, স্কুল-কলেজ এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ সবকিছু বন্ধ ছিল। তবে ধীরে ধীরে মুদ্রণশিল্প ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। ওয়াজ-মাহফিল ও নির্বাচনের কারণে আমাদের ক্ষতি কাটিয়ে উঠার পথ তৈরি হয়েছে।
মৌলভীবাজারে মুদ্রণ শিল্প তত বড় না হলেও করোনায় ক্ষতির মুখে পড়েছে তারাও। এখানেও পরিস্থিতি ভালো হচ্ছে। অংকন কম্পিটার্সের পরিচালক মুহিদুর রহমান জানালেন, অন্যান্যবারের মতো এবারে শীতে ওয়াজ মাহফিল বা কীর্তন হয়নি, ফলে ৪০% গ্রাহক কমে গেছে। শীতকালে বিভিন্ন পিঠা উৎসব বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হয় তাও এ বছর নাই। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে কোনভাবেই আমাদের ব্যবসা স্বাভাবিক হবে না।
তবে পাতাকুড়ি অফসেটের স্বত্বাধিকারী উমেদ আলী বললেন, করোনা শুরুর পর যে ধ্বস নেমেছিল তার থেকে এখন অবস্থা ভাল। পৌর নির্বাচনের সুযোগে কিছু বড় কাজ পেয়েছিলাম। এখন এত কাজ নেই তবে সাধারণ দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হচ্ছে।
অন্যদিকে যশোরেও বিভিন্ন পৌরসভার নির্বাচন চলছে। ২৮ ফেরুয়ারি কেশবপুর পৌরসভার নির্বাচন। চলতি মাসে মনিরামপুর ও বাঘারপাড়া পৌরসভার নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। সামনে যশোর পৌরসভার নির্বাচন। সব মিলিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে ছাপাখানার অর্থনীতি। কর্মীদের কাজের গতি বেড়েছে। কিন্তু কাগজের দাম বৃদ্ধি ও ভ্যাট অফিসের তৎপরতা ভাবিয়ে তুলছে ব্যবসায়ীদের।
যশোরের একতা প্রিন্টার্সের মালিক রকিব হোসেন স্বপন জানান, দীর্ঘ এক বছরের বেশি সময় ধরে ছাপাখানার কাজ বন্ধ ছিল। কেননা স্কুল-কলেজের কাজের উপর ছাপাখানা টিকে থাকে। এখনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ। পৌরসভার নির্বাচনে কাজের অর্ডার আসা শুরু হওয়ার পর অসাধু ব্যবসায়ীরা কাগজের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।কাগজের গ্রাম অনুযায়ী একশ থেকে ৩শ টাকা বেড়েছে। এতে ব্যবসায় সুবিধা করা যাচ্ছে না। তার উপর কড়া নাড়ছে কাস্টমের ভ্যাট বিভাগ। এতে চিন্তায় আছি কি করব।
সুলতান প্রেসের মালিক মো: ইসলাম জানান, পৌরসভার নির্বাচনকে ঘিরে পোস্টারের কাজ পাওয়া যাচ্ছে। এতে কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানো যাচ্ছে। এক বছর ব্যবসা না থাকায় পুঁজি হারিয়ে গেছে। চাকলাদার প্রিন্টিং প্রেসের ব্যবস্থাপক গোপিনাথ দাস জানান, জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে ৫০টি ছাপাখানা রয়েছে। মূলত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ বেশি হয়ে থাকে। তবে এক বছরের বেশি সময় এসব কাজ না থাকায় মালিকপক্ষ ভর্তুকি দিয়েছে। তবে নির্বাচনে কিছুটা চাঙ্গাভাব এসেছে।
[এই প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন: আজিজুল সঞ্চয়, খোরশেদ আলম, হোসেন শহীদ, রিপন দে ও আমাদের যশোর প্রতিনিধি]