মহাসড়কে পণ্যবাহী যানচালকদের বিশ্রামাগার: বর্ধিত সময়েও প্রকল্প শেষ হওয়া নিয়ে শংকা
টেকসই ও নিরাপদ মহাসড়ক গড়ে তোলার লক্ষে ৪টি জাতীয় মহাসড়কের পাশে পণ্যবাহী গাড়িচালকদের জন্য পার্কিং সুবিধা সম্বলিত বিশ্রামাগার স্থাপন প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ প্রকল্পের প্রথম কাজটি শুরু হয়েছে বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম মহাসড়কে, সিরাজগঞ্জের পাঁচলিয়ায়।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) অফিসের সাড়ে ১৩ একর নিজস্ব জায়গায় নির্মিত এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৪৩ কোটি টাকা। তবে নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে স্থাপনাগুলো নির্মাণ করায় প্রকল্পের স্থায়ীত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
অন্যদিকে, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের অর্ধেক কাজও শেষ করতে পারেনি। তাই ৪ মাস সময় বাড়ানো হয়েছে। বর্ধিত সময়েও প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়া নিয়ে শংকায় রয়েছে খোদ সওজ অফিস ও ট্রাকচালকরাও।
৩০ আগস্ট প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সাবস্টেশনসহ (বিশ্রামাগার) ভবন ও পার্কিংয়ের রাস্তা নির্মাণকাজ চলছে। তাতে ব্যবহার করা হচ্ছে মরিচা ধরা নন-গ্রেড রড, পোড়া মাটি সাদৃশ্য ইটের খোয়া, কাদামাটি ও ময়লা আর্বজনা মিশ্রিত সাদা পাথর, নন ব্যান্ডের স্যানেটারি পাইপ ও নিম্নমানের টাইলস।
গাথুনি ও ঢালাইয়ে ১.৫ এম.এম. চিকন বালি ও ২.৫ এম.এম. মোটা বালি ব্যবহারের নিয়ম। অথচ প্রকল্প এলাকায় কোথাও মোটা বালির দেখা মেলেনি। চিকন বালির পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে ধুলা মিশ্রিত নিম্নমানের বালি।
নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত সামগ্রীর গুণগতমান কিছুটা খারাপ স্বীকার করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সাগর বিল্ডার্সের সাইড ম্যানেজার শফিকুল ইসলাম বলেন, 'বাছাই করে খারাপ সামগ্রীগুলো বাদ দেওয়া হবে। ২.৫ এম.এম. মোটা বালি বর্তমানে সাইডে নেই, শিগগিরই তা আনা হবে।'
এসব দেখভাল করার জন্য প্রকল্প এলাকায় সার্বক্ষণিক সওজ অফিসের পদস্থ কর্মকর্তাদের উপস্থিত থাকার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু ওইদিন (৩০ আগস্ট) সওজ অফিসের দুজন কার্য সহকারী ছাড়া প্রকল্প এলাকায় অন্য কাউকে দেখা যায়নি।
এ বিষয়ে সিরাজগঞ্জ সড়ক ও জনপথ অফিসের কার্য সহকারী আলমগীর হোসেন বলেন, 'আমরাই নিয়মিত এখানে থাকি। স্যারেরা মাঝে মধ্যে আসে। তাছাড়া তাদের তো আরও কাজ থাকে, সেগুলোও দেখতে হয়।'
নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের বিষয়ে আলমগীর বলেন, 'এগুলো ব্যবহার করলে তেমন ক্ষতি হবে না।'
কাজের অগ্রগতি প্রসঙ্গে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সাগর বিল্ডার্সের সাইড ইঞ্জিনিয়ার জয় রায় বলেন, 'করোনার কারণে দু-দফায় সাড়ে ৪ মাস প্রকল্পের কাজ বন্ধ ছিল। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ হয়নি। তাই ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। কয়েকবার ডিজাইন পরিবর্তন হওয়ায় সাবস্টেশন ভবন (দ্বিতল) নির্মাণ কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। ইতোমধ্যে এটির ৬০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। পার্কিং রাস্তার কাজ হয়েছে ৬০ থেকে ৭০ ভাগ। ওয়ার্কসপ ভবন নির্মাণের নকশা এখনো হাতে আসেনি। সংযোগ সড়ক ও বাউন্ডারি ওয়ালসহ আনুষঙ্গিক অন্যান্য নির্মাণকাজ এখনো শুরু হয়নি।'
তিনি আরও বলেন, 'শুনেছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২২ অক্টোবর নিরাপদ সড়ক দিবসে এ প্রকল্প উদ্বোধন করবেন। যে কারণে অন্যসব কাজ বাদ রেখে রাত-দিন কাজ করে আমরা শুধু সাবস্টেশন ভবন ও পার্কিং রাস্তা প্রস্তুত করার চেষ্টা করছি।'
সিরাজগঞ্জ ট্রাক ও কার্ভাডভ্যান পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আকমল হোসেন বলেন, 'মহাসড়কে চলাচল করা পণ্যবাহী যানবাহনের চালকদের সুবিধার্থে পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের দাবির প্রেক্ষিতেই সরকার এ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত ১৪ মাসে প্রকল্পের অর্ধেক কাজও শেষ করতে পারেনি। আশংকা করা হচ্ছে, বাড়তি ৪ মাসেও তারা প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হবে।'
এছাড়া সওজ অফিসের সুষ্ঠু নজরধারির অভাব এবং নিম্নমানের পণ্যসামগ্রী ব্যবহার করে স্থাপনাসমূহ নির্মাণের অভিযোগ করে প্রকল্পের স্থায়ীত্ব নিয়েও শংকা প্রকাশ করেন তিনি।
সিরাজগঞ্জ সড়ক ও জনপথ অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলী দিদারুল আলম তরফদার জানান, 'প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বারবার তাগিদপত্র দেওয়া হয়েছে। তারপরও নির্ধারিত সময়ে তারা কাজ শেষ করতে পারেনি। ৪ মাস অতিরিক্ত সময় দেওয়া হয়েছে। বাড়তি সময়েও তারা কাজ শেষ করতে পারবে কি না, শংকায় আছি। যদি তারা ব্যর্থ হয়, তাহলে প্রকল্পের চুক্তিপত্র অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।'
নিম্নমানের পণ্য সামগ্রী ব্যবহার প্রসঙ্গে প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন নির্বাহী প্রকৌশলী। পাশাপাশি প্রকল্পের সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তাকে দ্রুত নমুনা পরীক্ষা করে দাখিল করারও নির্দেশ দেন।
এদিকে, প্রকল্পের ৫৫ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে দাবি করে নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, 'ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে সওজ প্রধান অফিস ইতোমধ্যে ৪২ ভাগ বিল পরিশোধ করেছে। তারা আরও কিছু টাকার জন্য আবেদন করলে সেটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।'
২২ অক্টোবর প্রকল্পটি প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধন করা প্রসঙ্গে নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, 'আমরা দ্রুত প্রকল্পের কাজ শেষ করার চেষ্টা করছি। সম্ভব না হলে উদ্বোধনের তারিখ পরিবর্তন হতে পারে।'
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার লিমিটেড, রানা বিল্ডার্স প্রাইভেট লিমিটেড ও মের্সাস সাগর বিল্ডার্স যৌথভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কাজ করছে। ২০২০ সালের ১১ মে থেকে ২০২১ সালের ২০ আগস্ট পর্যন্ত এ প্রকল্পের মেয়াদকাল ছিল, যা ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। ব্যয় ধরা হয়েছে ৪২ কোটি ৮০ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। অর্থায়ন করছে এডিপি (জিওবি)।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ২০২০ সালের ১৫ অক্টোবর এ প্রকল্পের ভিত্তিফলক উন্মোচন করেন। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে এখানে ৮০ থেকে ১০০টি ট্রাক পার্কিং করা যাবে। চালকরা আধুনিক সুবিধা সম্বলিত বিশ্রামাগার ব্যবহারের সুযোগ পাবেন। প্রকল্প এলাকার অভ্যন্তরে ক্যানটিন, গোসলখানা, নামাজ ঘর ও প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা কক্ষ থাকবে। গড়ে তোলা হবে আধুনিক লেক, সবুজায়ন ও বিনোদন পয়েন্ট। যানবাহনের ক্রটি মেরামতে থাকবে ওয়ার্কশপ। বেসরকারিভাবে গার্ড নিয়োগের মাধ্যমে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। পরিবহন চালকরা অল্প খরচে এখানে সবধরনের আধুনিক সুবিধা ভোগ করতে পারবেন।
সরকারি এ প্রতিষ্ঠান পাবলিক ইজারার ভিত্তিতে পরিচালিত হবে বলে জানিয়েছে সিরাজগঞ্জ সওজ অফিস।