মাদক মামলার জট কমাতে পুলিশের ব্যতিক্রমী উদ্যোগ
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের এই মহাদুর্যোগেও থেমে নেই মাদক কারবারিরা। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে দেশে ঢুকছে মাদক; যা ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে। গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে মাদক উদ্ধার, মামলা ও আসামি গ্রেফতারে হয়েছে নতুন রেকর্ড। মাদক উদ্ধারের ঘটনায় সারাদেশে দিনে গড়ে মামলা হচ্ছে ৩৫১টি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, মাদক উদ্ধারের প্রতিটি ঘটনায় থানায় মামলা দায়ের হলেও সাক্ষীরা যথাসময়ে আদালতে হাজির না হওয়ায় এবং সাক্ষ্য না দেওয়ায় দীর্ঘদিন ঝুলে থাকে মামলার বিচার কাজ।
অনেক মামলা আবার সাক্ষীর অভাবে নিষ্পত্তিও হয়ে যায়। এ ছাড়া মাদক উদ্ধার অভিযানে গিয়ে 'মাদক গায়েব' করার অভিযোগও থাকে অভিযানে অংশ নেওয়া পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে। সবকিছু মিলিয়ে মাদক উদ্ধার ও মামলার সাক্ষী নিয়ে উভয় সংকটে পড়তে হয় পুলিশ সদস্যদের।
তাই মাদক মামলার জট কমাতে এক ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পুলিশ। বাহিনীটির একাধিক কর্মকর্তারা বলছেন, মাদক উদ্ধার অভিযানে স্বচ্ছতা আনার পাশাপাশি সাক্ষীদের সাক্ষ্য দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে দেশে প্রথমবারের মতো ভিন্নধর্মী উদ্যোগ নিয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পুলিশ।
উদ্ধার অভিযান নিয়ে যেন কোনো প্রশ্ন না ওঠে এবং সাক্ষীরা যেন আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দিতে পিছু না হটেন- সেজন্য ঘটনাস্থল থেকেই উদ্ধারকৃত মাদকদ্রব্যের ভিডিওচিত্র ও সাক্ষীদের ছবি তুলছে পুলিশ।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পুলিশ সূত্র জানায়, মাস দুয়েক ধরে উদ্ধার অভিযানের ঘটনাস্থলের ভিডিওচিত্র ধারণের পাশাপাশি ঘটনাস্থল থেকে সাক্ষীদের ছবি তোলা হচ্ছে। মামলার নথিপত্রের সঙ্গে এসব ভিডিওচিত্র ও ছবি পাঠানো হচ্ছে জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতনদের কাছে। এখন পর্যন্ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ভিডিওচিত্র ও ছবির বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছেন।
তবে সবকিছু ঠিক থাকলে চলতি জুলাই মাস থেকেই আদালতে মামলার নথিপত্রের সঙ্গে ভিডিওচিত্র ও ছবি জমা দেওয়া হবে বলে জানা গেছে। এর ফলে ঘটনাস্থলে ছিলেন না বা মাদক উদ্ধার সম্পর্কে কিছুই জানেন না- এমন কথা আর বলতে পারবেন না সাক্ষীরা। জুলাই মাস থেকেই জেলার নয় থানায় দায়ের হওয়া মাদক মামলার নথিপত্রের সঙ্গে ভিডিওচিত্র ও ছবি আদালতে জমা দেবে পুলিশ।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, গত বছর সারাদেশে মাদক উদ্ধার, মামলা ও আসামি গ্রেফতারের ক্ষেত্রে রেকর্ড হয়েছে। ২০১৯ সালে মাদক নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে যুক্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এক লাখ ২৪ হাজার ৯৮টি মামলা করেছে। গড়ে প্রতিদিন মামলা হয়েছে ৩৪০টি। আর চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে মামলা হয়েছে ২১ হাজার ১১৬টি। এই হিসেবে গড়ে প্রতিদিন মামলা হয়েছে ৩৫১টি।
২০১৯ সালে মাদক সংশ্লিষ্ট মামলায় আসামি গ্রেফতার হয়েছে এক লাখ ৬২ হাজার ৮৪৭ জন। আর ২০২০ সালের প্রথম দুই মাসে আসামি গ্রেফতার হয়েছে ২৭ হাজার ৩৭২ জন। জাতিসংঘের মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ইউএনওডিসি বলছে, যত মাদক বিক্রি হয়, ধরা পড়ে তার মাত্র ১০ শতাংশ। এ হিসেবে গত বছর দেশে ইয়াবা বিক্রি হয়েছে ৩০ কোটি ৪৪ লাখ ৬৩ হাজার পিস, যার বাজারমূল্য প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকারও বেশি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর দফতর) আবু সাঈদ বলেন, আমরা যে মাদক উদ্ধার করি- এটা নিয়ে অনেক সময় কিছু কথা ওঠে। এই জায়গাটাতে স্বচ্ছতা আনার জন্যই মূলত আমাদের এই ভিডিওচিত্র ও ছবি তোলার উদ্যোগ।
''এ ছাড়া অনেক সাক্ষী আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য না দেওয়ায় মামলার বিচার কাজ ঝুলে থাকে। আমাদের উদ্যোগটি পুরোপুরি কার্যকর হলে সাক্ষীরা আর সাক্ষ্য দিতে অনীহা জানাতে পারবেন না। এখন পর্যন্ত আমাদের এই উদ্যোগটি কার্যকর এবং ফলপ্রসু হবে বলেই মনে হচ্ছে'', বললেন আবু সাঈদ।
গত ৮ জুন দুপুরে জেলার বিজয়নগর উপজেলার পূর্বভাগ থেকে যাত্রীবেশে অটোরিকশায় ওঠেন এমদাদুল হক (২০) নামে এক তরুণ। তার বাড়ি হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার কালিকাপুর গ্রামে।
অটোরিকশাটি কিছুদূর যাওয়ার পরই থামার সংকেত দেয় পুলিশ। এরপর শুরু হয় যাত্রীদের ব্যাগ তল্লাশি। এ সময় এমদাদুলের হাতে থাকা একটি ব্যাগ থেকে জব্দ করা হয় সাড়ে ছয় কেজি গাঁজা। এ ঘটনায় বিজয়নগর থানার উপ-পরিদর্শক হাসান খলিল উল্লাহ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা দায়ের করেন।
মামলায় সাক্ষী করা হয় অটোরিকশা চালক জনি মিয়াকে। ঘটনাস্থল থেকেই কাগজপত্রে জনির সাক্ষর নেয় পুলিশ। স্বাক্ষর দেওয়ার মুহূর্তের ছবিও ধারণ করা হয় পুলিশের সদস্যদের মোবাইলফোনে।
স্বাক্ষর নেওয়ার ছবি তুলতে দেখে প্রথমে কিছুটা ভয় পেলেও আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতেই ছবি ও ভিডিওচিত্র ধারণ করার বিষয়টি জানতে পেরে ভয় কেটে যায় তার।
জনি মিয়া বলেন, ওই তরুণ পূর্বভাগ থেকে পাইকপাড়া যাওয়ার জন্য আমার অটোরিকশায় ওঠেন। পথিমধ্যে জালালপুর আসার পর পুলিশ আমাকে থামার সংকেত দেয়। এরপর তল্লাশি করে এমদাদুলের ব্যাগ থেকে গাঁজা উদ্ধার করে পুলিশ।
''আমি সাক্ষী দিতে রাজি হওয়ার পর কাগজে আমার স্বাক্ষর নিয়ে ছবি তোলা হয়। ছবি তোলার বিষয়টি আমার কাছে ভালোই লেগেছে। আমিও চাই মাদক কারবারিদের শাস্তি হোক। সেজন্য আমি আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দিবো'', যোগ করেন তিনি।
গত ১৪ জুন বিজয়নগর উপজেলার সিঙ্গারবিল এলাকা থেকে ২৪ কেজি গাঁজা উদ্ধার মামলার সাক্ষী মো. মামুন জানান, সিঙ্গারবিল বাজারের সামনে থেকে গাঁজা উদ্ধার করে পুলিশ। মাদক কারবারিরেদ দৌঁড়ে গিয়ে আটক করা হয়। আমি এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। পুলিশ আমাকে ও সিঙ্গারবিল বাজারের পাহারাদারকে সাক্ষী হতে বলার পর আমরা সাক্ষী দিতে রাজি হই। এরপর কাগজে আমাদের স্বাক্ষর নেওয়া হয়। স্বাক্ষর দেওয়ার সময় পুলিশ আমাদের ছবিও তোলে।
বিজয়নগর থানার ওসি আতিকুর রহমান বলেন, আদালত থেকে সাক্ষীদের হাজির হতে বলা হলে অনেক সাক্ষীই হাজির হন না। আসামিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অনেক সাক্ষী আদালতে গিয়ে ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানেন না বলে জানান। এতে করে মাদক করাবারিরা পার পেয়ে যায়। এ ছাড়া মাদক উদ্ধার অভিযান নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তোলেন, সেজন্য আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে ঘটনাস্থল থেকে ভিডিওচিত্র ও সাক্ষীদের ছবি তুলে রাখা হচ্ছে। এ উদ্যোগটি মাদক মামলার বিচার কাজে যেমন সহায়ক হবে, তেমনি উদ্ধার অভিযানেও স্বচ্ছতা আসবে।
এ প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, আইনে না থাকলে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার এখতিয়ার পুলিশের নেই। ডিজিটাল এভিডেন্স নেওয়ার জন্য আইনের সংশোধন আনতে হবে বলে মনে করেন তিনি।