মেট্রো রেলের পারফরম্যান্স টেস্ট আজ
পারফরম্যান্স টেস্টের মাধ্যমে মূল ভায়াডাক্টে আজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হতে যাচ্ছে রাজধানী ঢাকায় মেট্রো টেনের যাত্রা। উত্তরা নর্থ থেকে পল্লবী পর্যন্ত ছয় কিলোমিটারের বেশি এলাকা জুড়ে চারটি স্টেশনে মেট্রো রেলের পারফরম্যান্স টেস্ট উদ্বোধন করবেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
অবশ্য এর প্রস্তুতির অংশ হিসেবে গত শুক্রবার সকালে এক দফায় এই চার স্টেশনের মধ্যে মেট্রো ট্রেন পরিচালনা করা হলে মিরপুর এলাকাবাসীর মধ্যে উল্লাস ছড়িয়ে পড়ে। রাজধানীর উত্তরা, পল্লবী, মিরপুর এলাকার মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে মেট্রো রেল। কয়েক বছরের দুর্ভোগ পোহানোর পর এখন সবাই নগরীর এ নতুন বাহনে চড়ার অপেক্ষা করছেন।
২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ থাকলেও উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১.৭৩ কিলোমিটারে গত বছরের ডিসেম্বরেই মেট্রো রেল পরিচালনার কথা ছিল। গুলশানে হলি আর্টিজানে হামলার কারণে ছয় মাস কাজ বন্ধ থাকা ও পরবর্তীতে করোনার কারণে এর কাজ পিছিয়ে যায়। এবার আগামী বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে মেট্রো রেল চালু করতে চায় কর্তৃপক্ষ।
উত্তরা-আগারগাঁও অংশে ভায়াডাক্ট স্থাপনের কাজ শেষ হলেও ৯টি স্টেশনের মধ্যে কাজ শেষ হয়েছে চারটির। এ কারণে প্রথম মেট্রো ট্রেনের পারফরম্যান্স টেস্টও পরিচালনা করা হবে এ চার স্টেশনের মধ্যেই।
কবে মেট্রো রেল পরিচালনা করা হবে তা জানতে চাইলে মেট্রো রেলের নির্মাণ ও পরিচালনায় নিয়োজিত সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন সিদ্দিক বলেন, পারফরম্যান্স টেস্টের মাধ্যমে ট্রেনের কোচ আর লাইনের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হবে।
সফলভাবে এ টেস্ট পরিচালনার পর বিভিন্ন স্টেশনে স্থাপন করা সিস্টেম সঠিকভাবে কাজ করছে কি না তা যাচাইয়ে ইন্টিগ্রেটেড টেস্ট পরিচালনা করা হবে। ইন্টিগ্রেটেড টেস্টের পরে পরিচালনা করা হবে ট্রায়াল রান।
সব ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষার পর কবে নাগাদ মেট্রো রেল পরিচালনা করা হবে তা আজকের অনুষ্ঠানে ঘোষণা করা হবে বলেও তিনি জানান।
এর আগে তিনি টিবিএসকে জানিয়েছিলেন, এক সেট ট্রেন আসার পর প্রায় দুই ডজন পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হয়। তা ছাড়া প্রতিটি স্টেশনে প্রায় দেড় ডজন অবকাঠামো ও সিস্টেমের সঙ্গে লাইনের সংযোগ স্থাপন করতে হয়।
রাজধানীর উত্তরার তৃতীয় পর্যায় থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০.১০ কিলোমিটার মেট্রো রেল নির্মাণের প্রকল্প নেয়া হয় ২০১২ সালে। পরবর্তীতে এ মেট্রো রেলের লাইন কমলাপুর পর্যন্ত সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত হয়। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে দেশের প্রথম মেট্রো রেলের দৈর্ঘ্য হবে ২১.২৬ কিলোমিটার।
অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা উত্তরা আগারগাঁও পর্যন্ত লাইনের সার্বিক অগ্রগতি দাড়িয়েছে ৮৮.১৮ শতাংশে। অংশের চার স্টেশন উত্তরা উত্তর, কেন্দ্রীয় উত্তরা, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবীর নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। মিরপুর-১১, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও স্টেশনের সাব স্ট্রাকচার, কনকোর্স ছাদ নির্মাণের পর প্ল্যাটফর্ম ও স্টিল রুফ স্ট্রাকচার নির্মাণের কাজ চলছে।
পরিকল্পনা কমিশনের আইএমইডি সূত্র জানায়, পুরো ২০ কিলোমিটারে মেট্রো রেল চালু করতে ২৪ সেট ট্রেনের প্রয়োজন হবে। আর উত্তরা আগারগাঁও পর্যন্ত চালু করতে ট্রেন লাগবে আট সেট।
এ পর্যন্ত দেশে চার সেট ট্রেন এসেছে। আগামী মাসের শুরুতে আরও এক সেট ট্রেন জাপান থেকে আসার কথা রয়েছে। এ বিবেচনায় আগারগাঁও পর্যন্ত প্রথম দফায় চালু হবে মেট্রো রেল।
ডিএমটিসিএল সূত্র জানায়, মেট্রো রেলের আগারগাঁও স্টেশনে ট্রেনের লাইন ইন্টারচেঞ্জের সুযোগ থাকবে। এরপরে এমন সুযোগ থাকবে লাইনের দুই প্রান্তে। এ হিসাবে কমলাপুর স্টেশনের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত উত্তরা-আগারগাঁওয়ের মধ্যেই ট্রেন পরিচালনা করতে হবে।
ট্রেনের বৈশিষ্ট্য
২০১৭ সালে সই করা ২৮৭০ কোটি টাকা চুক্তির আওতায় জাপানের কাওয়াসাকি-মিতসুবিশি কনসোর্টিয়াম ২০১৯ সালের শুরুতে বগি নির্মাণ কাজ শুরু করে। যাত্রীবাহী কোচ নির্মাণের কাজ শুরু হয় ওই বছরের এপ্রিলে। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্মাণ হয়েছে পাঁচ সেট ট্রেন। সব মেট্রো রেল সরবরাহের চুক্তির মেয়াদ আগামী বছরের ডিসেম্বরে শেষ হবে।
মেট্রো ট্রেনের মোটর কার ও ট্রেইলারের বডিতে ব্যবহার করা হয়েছে এলুমিনিয়াম এলয়। ব্যবহার করা হয়েছে বুলেটপ্রুফ কাঁচ।
ছয় কোচের প্রতি সেটের দুই প্রান্তে থাকবে দুইটি ট্রেইলার কন্ট্রোল। মাঝে থাকবে তিনটি মোটরকার ও একটি ট্রেইলার।
২২ টন থেকে ২৮ টন ওজনের এসব কারের প্রস্থ ২.৯৫ মিটার। ২০ মিটার দীর্ঘ কামরায় লম্বালম্বি আসন পাতা থাকবে। প্রতি সেট মেট্রোতে ১৬৯৬ যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হবে।
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এ সব কোচের প্রতিটিতে ব্যবহার করা হবে দুইটি এয়ার কন্ডিশনিং ইউনিট।
ট্রেনের প্রতি প্রান্তে চারটি করে দরজা রয়েছে। ট্রেনে প্রাধান্য থাকছে লাল ও সবুজ রংয়ের।
সেকেন্ডের ব্যবধানে এ সব ট্রেনের গতি ঘন্টায় ৩.৫ কিলোমিটার বাড়ানো যাবে। প্রতি ঘন্টায় সর্বোচ্চ ১০০ কিলোমিটার গতিতে চলবে ট্রেন।
নারী ও প্রতিবন্ধীদের জন্য থাকছে বিশেষ ব্যবস্থা
মেট্রো রেলের প্রতি সেটের একটি কোচ নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। অন্যান্য কোচে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও ভ্রমণ করতে পারবেন। গর্ভবতী মহিলা ও অতিরিক্ত বয়সীদের জন্য প্রতি কোচে থাকবে সংরক্ষিত আসন।
প্রতিবন্ধীদের জন্য কোচের ফ্লোর এবং প্ল্যাটফর্মের মধ্যে উচ্চতার সমতা রাখা হবে। কোচ ও প্ল্যাটফর্মের মাঝে ফাঁকা জায়গা থাকবে ন্যূনতম। ট্রেনের উভয় প্রান্তের কোচে হুইল চেয়ারের জন্য নির্ধারিত স্থান থাকবে।
দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য ট্রেনে থাকবে অডিও ইনফরমেশন সিস্টেম। আর শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের জন্য থাকবে ভিজ্যুয়াল ডিসপ্লে ও মনিটর।
স্বয়ংক্রিয় ট্রেন পরিচালনায় লাগবে ১৮ মেগাওয়াট বিদ্যুত
সম্পূর্ণ চালু হলে মেট্রো রেল পরিচালনায় ১৮ মেগাওয়াট বিদ্যুত প্রয়োজন হবে। মতিঝিল আরএসএস থেকে ডিপিডিসি এবং উত্তরা আরএসএস থেকে ডেসকো বিদ্যুত সরবরাহ করবে।
কোন সাব-স্টেশন বিকল হলে ট্রেন পরিচালনা অব্যাহত রাখতে ব্যবহার করা হবে রিং সার্কিট ট্রপোলজি প্রযুক্তি। এরপরেও সম্ভাব্য বৈদুতিক সমস্যায় রাখা হচ্ছে ব্যাকআপ সোর্স পাওয়ার। তবে এতে নবায়নযোগ্য জ্বালানী ব্যবহারের কোন সুযোগ থাকছে না।
রক্ষা পাবে সময় ও পরিবেশ
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার রাস্তা মাত্র ৪০ মিনিটে পাড়ি দেবে মেট্রো রেল। এতে যাত্রীদের সময় বাঁচবে দুই ঘন্টা করে, সাশ্রয় হবে কর্মঘণ্টার।
এ রুটে প্রতি ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন সম্ভব হবে।
এই প্রকল্পের সুবাদে প্রতি বছর কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ কমবে ১৭৩৩১২ টন। এর ফলে পরিবেশের সুরক্ষা হবে।
প্রসঙ্গত, ২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকা মহানগরী ও এর আশেপাশে ডিএমটিসিএল এর অধীনে ছয়টি মেট্রো রেল নির্মাণ করতে চায় সরকার। এ সব লাইনের মোট দৈর্ঘ্য হবে ১২৮.৭৪ কিলোমিটার।
এর মধ্যে ৬৭.৫৭ কিলোমিটার উড়াল ও ৬১.১৭ কিলোমিটার পাতাল রেল হবে। উড়াল ৫১টি ও পাতাল ৫৩টি মিলে মোট মেট্রো স্টেশন হবে ১০৪।