যেভাবে বাড়ি-গাড়ি-টাকার মালিক হলেন পাপিয়া দম্পতি
র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া শামীমা নূর পাপিয়া-মফিজুর রহমান দম্পতির অঢেল সম্পদ ও একাধিক গাড়ি-বাড়ির খোঁজ মিলেছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তাদের গ্রেপ্তারের পর টানা ১৬ ঘণ্টা নরসিংদী ও রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়েছে র্যাব।
অভিযানে রাজধানীর ফার্মগেট ২৮ ইন্দিরা রোডের বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা, বিদেশি মদ, পিস্তল ও গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। জানা গেছে, কিভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে পাপিয়া দম্পতি গাড়ি-বাড়ির মালিক হয়েছেন।
রোববার বিকেল ৫টায় রাজধানীর কারওয়ান বাজার মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাব -১-এর সিও (কমান্ডিং অফিসার) লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাফী উল্লাহ বুলবুল এসব তথ্য তুলে ধরেন।
এদিকে প্রতারণা, অবৈধ অর্থ পাচার, জাল টাকা সরবরাহ, মাদক ব্যবসা ও অনৈতিক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে যুব মহিলা লীগের নেত্রী শামীমা নুর পাপিয়াকে (২৮) আজীবনের জন্য বহিষ্কার করেছে সংগঠনটি। রোববার যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নাজমা আকতার ও সাধারণ সম্পাদক অপু উকিল স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাফী উল্লাহ বুলবুল জানান, গতকাল বেলা ১১টার দিকে পাপিয়াসহ চারজনকে আটকের পর তাদের দেওয়া তথ্যমতে অভিযান শুরু হয়। সারারাত অভিযান চলার পর আজ দুপুরে সেটি শেষ হয়। ফার্মগেট ২৮ ইন্দিরা রোডের 'রওশনস ডমিনো রিলিভো' নামে বিলাসবহুল ভবনে তাদের দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে।
সেখানে অভিযানের সময় লাইসেন্সবিহীন একটি বিদেশি পিস্তল, দুটি ম্যাগজিন, ২০ রাউন্ড গুলি, ৫ বোতল বিদেশি মদ, নগদ ৫৮ লাখ ৪১ হাজার টাকা, ৫টি পাসপোর্ট, ৩টি চেক বই, কিছু বিদেশি মুদ্রা ও বিভিন্ন ব্যাংকের ১০টি ভিসা ও এটিএম কার্ড উদ্ধার করা হয়।
র্যাবের অধিনায়ক বলেন, এই জিজ্ঞাসাবাদে বর্তমান সম্পদ ও বিলাসবহুল জীবন সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে। সুনির্দিষ্ট কোনো পেশা না থাকা সত্ত্বেও এই দম্পতি স্বল্প সময়ে বিপুল সম্পত্তি ও অর্থ বিত্তের মালিক হয়েছেন। ফার্মগেটে দুটি ফ্ল্যাট, নরসিংদী শহরে দুটি ফ্ল্যাট ও দুটি দুই কোটি টাকা দামের প্লট, বিলাসবহুল ৪টি গাড়ি এবং বিএফডিসির সামনে কার এক্সচেঞ্জ নামে একটি গাড়ির শোরুম রয়েছে তাদের।
কার এক্সচেঞ্জ শোরুমে পাপিয়ার এক কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। নরসিংদী শহরে কেএমসি কার ওয়াস অ্যান্ড অটো সলিউশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেখানে ৪০ লাখ টাকা বিনিয়োগ রয়েছে তাদের। এছাড়া দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে নামে ও বেনামে অ্যাকাউন্ট খুলে বিপুল পরিমাণ অর্থ গচ্ছিত রেখেছেন বলে জানিয়েছেন আসামিরা। এ ব্যাপারে র্যাবের অনুসন্ধান অব্যাহত রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, গত বছরের ১২ অক্টোবর থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনের ২১ তলার প্রেসিডেন্ট কক্ষ ভাড়া নিয়ে এই দম্পতিকে অবস্থান করতে দেখা যায়। সেখানে তারা ৫৯ দিনে মোট ৮১ লাখ, ৪২ হাজার ৮৮৮ টাকা বিল পরিশোধ করেছেন। এর বাইরে হোটেলের বার এককভাবে ভাড়া নিয়ে প্রতিদিন আড়াই লাখ টাকা বিল দিতেন। এত বিপুল অর্থের উৎস জানতে চাইলে তারা কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।
প্রাথমিক অনুসন্ধানে টাকার উৎস সম্পর্কে কিছু তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এ ব্যাপারে র্যাবের সিও বলেন, পাপিয়া ও তার স্বামী মফিজুর রহমান নরসিংদী এলাকায় অবৈধ অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, চাকরি দেওয়ার নাম করে টাকা নিয়ে প্রতারণা, জমির দালালি, সিএনজি পাম্পের লাইসেন্স প্রদান, গ্যাস লাইন সংযোগ ইত্যাদির নামে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।
এই পর্যন্ত পাওয়া তথ্যমতে, পাপিয়া দম্পতি পুলিশের এসআই ও বাংলাদেশ রেলওয়েতে বিভিন্ন পদে চাকরি দেওয়ার নামে ১১ লাখ টাকা, একটি কারখানায় অবৈধ গ্যাস সংযোগ দেওয়ার কথা বলে ৩৫ লাখ টাকা, একটি সিএনজি পাম্পের লাইসেন্স দেওয়ার নাম করে ২৯ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। তবে টাকার বিনিময়ে কারও কোনো সংযোগ দিতে পারেননি তারা। তাছাড়া নরসিংদী এলাকায় চাঁদাবাজি, মাদক, অস্ত্র ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে উপার্জন করেছেন।
শাফী উল্লাহ বুলবুল বলেন, পাপিয়া দম্পতির আয়ের আরেকটি উৎস হচ্ছে, নারীদের দিয়ে জোরপূর্বক অনৈতিক কাজ করানো। তারা ঢাকার বিভিন্ন বিলাসবহুল হোটেলে অবস্থান করে কম বয়সি মেয়েদের দিয়ে জোরপূর্বক অনৈতিক কাজে বাধ্য করে। এদের অধিকাংশকেই নরসিংদী এলাকা থেকে চাকরি দেওয়ার কথা বলে এবং বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে আসা হতো। এসব অনৈতিক কাজে কেউ অস্বীকৃতি জানালে পাপিয়া দম্পতিসহ আসামীরা বিভিন্নভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতেন বলে জানিয়েছেন উদ্ধার হওয়া মেয়েরা।
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, নরসিংদীতে এই দম্পতির 'কিউ অ্যান্ড সি' নামে একটি ক্যাডার বাহিনী রয়েছে। ওই বাহিনীর প্রত্যেক সদস্যের হাতে ট্যাটু করা আছে। তাদের কাছে সব সময় আগ্নেয়াস্ত্র থাকে। তাদের দুটি হাইয়েচ গাড়ি দেওয়া হয়েছে। তারা সেই গাড়িতে চড়ে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজ করে বেড়ায়। তাদের ৫টি মোটরসাইকেলও রয়েছে। এসব গাড়িতে মাসোহারা আদায়, চাঁদাবাজির টাকা উত্তোলন, অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা দেখাশোনা করতো তারা। তাদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে।
এক প্রশ্নের জবাবে র্যাব-১-এর অধিনায়ক বলেন, 'টাকা ব্যাংকে না রেখে বাসায় কেন রেখেছেন- তার কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি পাপিয়া। আমরা অনুসন্ধান করছি, টাকার উৎস বের হবে।'
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রথমে অর্থ পাচার ও জাল মুদ্রা রয়েছে- এমন তথ্যের ভিত্তিতে পাপিয়া, তার স্বামী মফিজুর রহমান ও তাদের দুই সহযোগীকে আটক করা হয়। এরপর চাঞ্চল্যকর তথ্যগুলো বেরিয়ে আসে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে সিও বলেন, কারও সঙ্গে ছবি থাকলেই যে কেউ জড়িত থাকবে, তা নয়। এখন যেকেউ ছবি তুলতে চাইলে অনুমতি দেন। এসব দায় ব্যক্তিকেন্দ্রিক। আমরা আসামীদের বিরুদ্ধে বিমানবন্দর থানায় অস্ত্র, মাদক ও অর্থ পাচার মামলা দিয়ে আদালতে পাঠিয়েছি।