রাস্তা প্রশস্ত হওয়ায় কমেছে দুর্ঘটনা
ঢাকা- চট্টগ্রাম বা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষের ভয়াবহ চিত্র প্রায়শই খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় দেখতে পাওয়া যায়।
যখন প্রধান এই দুইটি মহাসড়ক ডিভাইডারসহ চার লেনে উন্নীত করা হলো, স্বাভাবিক ভাবেই ধরে নেওয়া হয় সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যাও কমে আসবে।
দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা মিলিয়ে দেখা যায়, এসব রাস্তায় নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে অনেকটাই। রাস্তা চওড়া করে আলাদা লেন করার সুফলও পাওয়া গেছে।
২০১৭ সালে মহাসড়ক দুটি দুই লেন থাকার সময়কার দুর্ঘটনা, মৃত্যু ও হতাহতের সংখ্যা এবং ২০২০ সালের হিসাব মিলিয়ে দেখেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।
২০১৭ সালের পর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দুর্ঘটনার সংখ্যা কমেছে ৩২ শতাংশ ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে কমেছে ৩৭ শতাংশ।
২০১৭ সালের তুলনায় গত বছর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দুর্ঘটনায় মৃত্যুহার কমেছে ৪৬ শতাংশ। তবে ময়মনসিংহ সড়কের মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পায়নি, কমেছে মাত্র ১৬ শতাংশ।
পুলিশ ও পরিবহন বিশেষজ্ঞদের মতে, ফুট ওভার ব্রিজের অভাবের কারণেই এখনো ঝুঁকি কমেনি ময়মনসিংহ সড়কের। চট্টগ্রাম মহাসড়কে ফুটওভার ব্রিজ থাকায় এখানে মৃত্যুহারও কম বলে ধারণা করছেন তারা।
অনেকেই রাস্তা পার হওয়ার সময়ে দৌড়ে পার হওয়ার চেষ্টা করেন ও দুর্ঘটনার মুখে পড়েন।
মহাসড়ক পুলিশ ম্যাপে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিস্তার ২ ভাগে বিভক্ত, কাঁচপুর থেকে ভবেরচর পয়েন্ট এবং কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে চট্টগ্রাম সিটি গেট পয়েন্ট।
সংগৃহীত তথ্য থেকে দেখা যায়, কাঁচপুর ও মেঘনা নদীর নিকটবর্তী ভবেরচরের মধ্যে ৩৯ কিলোমিটার বিস্তার না থাকলে এই মহাসড়ক আরও নিরাপদ হতো।
কাঁচপুর হাইওয়ে পুলিশের অফিসার ইন-চার্জ মনির জামান জানান, কাঁচপুর ব্রিজের রাস্তায় বিপজ্জনক মোড় নেওয়া ও কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়া ওই ভাগের দুর্ঘটনার জন্য দায়ী।
তবে অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক ড. মো. হাদিউজ্জামান জানান, মহাসড়কের ওই অংশে বেশি দুর্ঘটনার কারণ যানবাহনের গতির অসামঞ্জস্যতা, মহাসড়কের সাথে বিচ্ছিন্নভাবে স্থানীয় সড়কের সংযোগ, রাস্তার পাশের বাজার ও উল্টোদিক থেকে আসা ছোট যানবাহন ।
তিনি জানান, ঢাকা- সিলেট রুট ও অন্যান্য রাস্তার নিম্ন গতির যানবাহন মহাসড়কে প্রবেশের সংযোগস্থলে আলাদা ট্রাফিক ব্যবস্থা না থাকা যানবাহগুলো ওই অংশে প্রবেশ করব। অনেক ক্ষেত্রে গতির অসামঞ্জস্যতার কারণেই দুর্ঘটনা ঘটে।
মহাসড়ক প্রশস্তিকরণের সুফল পেতে ইন্টারসেকশনে গ্রেড সেপারেশনের মাধ্যমে যানবাহন প্রবেশ নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দেন তিনি।
লালপোল: ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্র
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার অংশে বিপজ্জনক মোড়ের ও বেপরোয়া রাস্তা পারাপার ও গাড়ি চালানোর সতর্কবার্তা হিসেবে বিপদসংকেত আছে। তবে মহাসড়কের ফেনীর অংশে এধরনের কোনো বিপদসংকেত নেই।
রেল লাইন ও মহীপাল মোড় পেরিয়ে দুটি ফ্লাইওভার অতিক্রম করার পর অটোরিকশাগুললোর মহাসড়ক অতিক্রম করার অনুমতি জন্য দ্রুতগামী যানবাহনগুলিকে লালপোলের একটি অননুমোদিত সিগন্যালে হঠাৎ থামতে হয়।
মাত্র এক কিলোমিটার অদূরেই একটি ফাঁক রয়েছে, তবে তিন চাকার যানবাহনগুলো শর্টকাট ব্যবহার করে এবং সোনাগাজী উপজেলা সংযোগকারী রাস্তা থেকে আসা- যাওয়ার পথে মহাসড়ক অতিক্রম করে।
মহাসড়কের যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে অন্তত তিনজন সেখানে দায়িত্বরত থাকেন, তারা যানবাহনগুলোকে মহাসড়ক অতিক্রম করার অনুমতি দেন । মহাসড়ক ব্যবহারের জন্য অটোরিকশা থেকে সংগ্রহ করা টোল থেকে তাদেরকে অর্থ প্রদান করা হয়।
পুলিশের সংগৃহীত তথ্য থেকে দেখা যায়, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কটিতে গত চার বছরে সড়ক দুর্ঘটনার মৃত্যুহার বেশ উদ্বেগজনক। ২০১৯ ছাড়া বাকি তিন বছরই মৃত্যু সংখ্যা একশো ছাড়িয়েছে।
২০১৭ সালে দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল ১৩৫ এবং প্রাণহানির সংখ্যা ১৫৪। পরের বছর ২০১৮ সালে দুর্ঘটনার সংখ্যা কিছুটা কমে ১২৪ এ দাঁড়ালেও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে ১৯৮ তে দাঁড়ায়। ২০১৯ সালে দুর্ঘটনার সংখ্যা কিছুটা কমে আসে। সেবছর ১০১ টি দুর্ঘটনায় ৭২ জন মারা যান। ২০২০ সালে আবারও দুর্ঘটনার সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যায়। ২১১ টি দুর্ঘটনায় মৃত্যবরণ করেন ১৩০ জন।
হাইওয়ে পুলিশের পুলিশ সুপার (অপারেশন ও স্পেশাল অ্যাফেয়ারস) রহমত উল্লাহ বলেন, ঢাকা-চাট্টগ্রাম মহাসড়কের রাস্তা সমতল, বেশ কয়েকটি ফুট ওভার ব্রিজ রয়েছে এবং "রাস্তায় কোনও বাজার নয়" নীতি কঠোরভাবে মেনে চলা হয়।
তবে ১১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে একটি ফুটওভার ব্রিজও নেই, এর কিছু অংশে নিষিদ্ধ তিন চাকার যানবাহন চলাচল করে- এসব কারণই মহাসড়কটিকে দুর্ঘটনাপ্রবণ করে তুলেছে বলে জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।
'নিষিদ্ধ তিন চাকার যানবাহন চলচকে মহাসড়ক আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। তাছাড়া, কোনও ফুট ওভার ব্রিজ না থাকায় যানবাহন চলাচলের মধ্যেই পথচারীরা রাস্তা পার হন।' যোগ করেন তিনি
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের কিছু অংশ ভেঙে পড়ায় পুরো রুটে সাধারণ যানবাহন চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে বলে জানান তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে।
ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের উঁচুনিচু রাস্তা
যদিও সড়ক দুর্ঘটনায় মুখোমুখি সংঘর্ষই সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, গত বছরের তথ্যে সড়ক দুর্ঘটনার ধরনে পরিবর্তন দেখা গেছে। গত বছরের তথ্যানুযায়ী, মহাসড়কের বেশিরভাগ দুর্ঘটনাই ছিল পেছন দিক থেকে সংঘর্ষ।
পথচারীদের মহাসড়ক পারাপার, রাস্তায় স্থানীয় বাজার এবং যানবাহনের গতি-অসঙ্গতিই মহাসড়কে পেছন দিক থেকে সংঘর্ষের প্রধান কারণ।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বাসচালক আবদুল মালেক জানান, ২০১৩ সালের আগে মহাসড়কে মুখোমুখি সংঘর্ষ সাধারণ ব্যাপার ছিল।
"এখন রাস্তাটি এতটাই সমতল যে এ জাতীয় সংঘর্ষ এখন বিরল ," যোগ করেন তিনি।
দুর্ঘটনার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হাইওয়ে পুলিশ কর্মকর্তা রহমত উল্লাহ বলেন, "দ্রুতগতির যানবাহনগুলো বেশিরভাগ সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং ওভারটেক করার সময় পিছন দিক থেকে ধীরগতির চলন্ত গাড়িগুলোর সাথে সংঘর্ষ হয়।"
উভয় মহাসড়কের চারলেনেই ডিভাইডার (বিভাজক) রয়েছে, ফলে মুখোমুখি সংঘর্ষের সংখ্যাও কমেছে। তবে এখনও মুখোমুখি সংঘর্ষের সংখ্যা বেশ উদ্বেগজনক।
গত বছর পেছন দিক থেকে সংঘর্ষের সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ, ৭৯৩টি। অন্যদিকে মুখোমুখি সংঘর্ষের সংখ্যা ছিল ২৮৭।
হাইওয়ে পুলিশের বিশ্লেষণে বলা হয়, কাভার্ড ভ্যান, সিএনজি অটোরিকশা এবং অন্যান্যরা বেশিরভাগ মুখোমুখি সংঘর্ষের কারণ ছিল।
পুলিশের তথ্যানুযায়ী, গত বছর দ্রুতগতির কারণে দুর্ঘটনা ঘটে ৪৮৯টি। আর ২২৪ টি দুর্ঘটনা ঘটে যানবাহন উল্টে যাওয়ার কারণে।
বেশিরভাগ দুর্ঘটনাই সকালে
হাইওয়ে পুলিশ জানিয়েছে, গত তিন বছরে বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটে সকাল ৭টা- ৮টার মধ্যে। অন্যদিকে মধ্যরাতে সবচেয়ে কম দুর্ঘটনা ঘটে।
পুলিশ বলছে, চালকরা সারা রাত গাড়ি চালানোর পর সকালে তাদের ঘুম পেতে শুরু করে। এছাড়াও সকালে যানবাহনের প্রচুর ভীড় থাকে।
অন্যদিকে, মধ্যরাতে রাস্তাগুলো তুলনামূলকভাবে কম যানজট থাকে।
পুলিশ জানিয়েছে, গত বছর সকাল ৬টা -১২ টার মধ্যে ৬২৯টি দুর্ঘটনা ঘটে, দুপুর ১২টা- সন্ধ্যা ৬টায় ৫৫৮টি এবংসন্ধ্যা ৬টা-রাত ১২টার মধ্যে এ সংখ্যা ছিল ৩৪৪টি।
চালকদের বক্তব্য
ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটের বাসচালক দেলোয়ার হোসেন জানান, রুটের অনেক প্রান্তে এত বেশি গর্ত গড়ে আছে যে তাদের এসব ক্ষেত্রে প্রতিবার গতি কমিয়ে পার হতে হয়।
"চালকরা সমতল রাস্তায় পৌঁছানোর পর সময় বাঁচাতে গতি বাড়িয়ে দেয়," বলেন তিনি
রাজধানীর উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এবং এর উপকেন্দ্রগুলোতে নতুন নতুন কারখানা নির্মাণের ফলে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে আরও বেশি যানবাহন চলাচল শুরু হয়েছে।
দেলোয়ার জানান, চার লেনও এখন এই পথে এতো বর্ধিত সংখ্যক যানবাহন চলাচলের জন্য যথেষ্ট নয়।
এদিকে, ঢাকা-সোনাগাজী রুটের বাসচালক মোহাম্মদ খোকন জানিয়েছেন, তিনি এবং ঢাকা-চাট্টোগ্রাম মহাসড়কের অন্যান্য চালকরা বিপরীত দিক থেকে আসা অটোরিক্সার কারণে বিপাকে পড়েছেন।
"তারা স্থানীয় হওয়ায় আমরা তাদের কাছে কিছু বলার সাহস পাই না।" বলেন তিনি।
খোকন বলেন, ধীরগতির কাভার্ড ভ্যানগুলোর কারণে তারা গতি কমাতে বাধ্য হন, ফলে গতির অসামঞ্জস্যতা তৈরি হয়।
"একটি পুরো লেন দখল করে কাভার্ড ভ্যানগুলো প্রতি ঘন্টায় ৪০-৫০ কি.মি বেগে চলে, যেখানে মহাসড়কের যানবাহন চলাচলের গড় গতি ঘন্টায় ৮০ কিলোমিটার," বলেন এই চালক।
'শুধু চার লেন সমস্যার সমাধান করবে না'
এআরআই'র পরিচালক ড. মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ঢাকা-চট্টোগ্রাম ও ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে চার লেন দুর্ঘটনা হ্রাসের ক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক ভূমিকা রাখেনি।
"গত বছর দুটি বড় মহাসড়কে দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা কম ছিল। তবে এটি চার লেনের কারণে নয় বরঙ মহামারীজনিত কারণে সারাবছর মানুষের সীমিত চলাচলের জন্যই এ চিত্র দেখা গেছে," বলেন তিনি।
এআরআই পরিচালক টিবিএসকে আরও বলেন, শুধু চার লেন বা রাস্তা প্রশস্ত করলেই সমস্যার সমাধান হবে না।
"দুর্ঘটনা রোধ করতে আমাদের নৌ পরিবহন এবং রেল পরিবহনের বিকাশে জোর দিতে হবে," যোগ করেন তিনি।
কর্তৃপক্ষ কী বলছে?
হাইওয়ে পুলিশ কর্মকর্তা রহমত উল্লাহ বলেন, গতি কমানোর জন্য তারা ঢাকা-চাট্টগ্রাম মহাসড়কে স্পিড গান এবং ক্লোজ সার্কিট টেলিভিশন (সিসিটিভি) ক্যামেরা চালু করেছেন।
মহাসড়কটি চলাচল স্বাভাবিক ও দখলমুক্ত রাখতে পুলিশ সার্বক্ষণিক টহল দেয় বলে জানান তিনি। এছাড়া তারা রাস্তায় এবং রাস্তার পাশে বাজারের ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করা হয় বলে জানান তিনি।
হাইওয়ে পুলিশ জানিয়েছে, তারা ২০২০ সালেই ঢাকা-চাট্টোগ্রাম মহাসড়কের ১৭৪ টি অস্থায়ী বাজার উচ্ছেদ করেন।
কুমিল্লা অঞ্চলের পুলিশ সুপার মো. নজরুল ইসলাম (সম্প্রতি অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক পদে পদোন্নতি পেয়েছেন) টিবিএসকে বলেন, তারা লালপোলে অটোরিকশা পারাপারের বিষয়টির ব্যাপারে অবগত আছেন।
"স্থানীয় রাজনীতিবিদ, প্রশাসন এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাই এই পারাপারের অনুমতি দেয়। তবে আমরা কর্তৃপক্ষের কাছে ওই জায়গায় একটি আন্ডারপাসের পরামর্শ দিয়েছিলাম," বলেন নজরুল ইসলাম।
এদিকে, হাইওয়ে পুলিশ প্রধান মল্লিক ফকরুল ইসলাম টিবিএসকে জানিয়েছেন, তদের চলমান সচেতনতামূলক প্রচারণার অংশ হিসাবে চালকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন তারা।
তিনি বলেন, পুলিশ গত বছরের ডিসেম্বরে ২ হাজার ৪৮৬ জন বাস ও ট্রাকচালককে সড়ক নিরাপত্তায় প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। এছাড়াও বিভিন্ন এলাকার হাইওয়ে পুলিশ চালকদের জন্য মাসিক কর্মশালার আয়োজন করে থাকেন।