রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ছে
কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মধ্যে ৫টি ক্যাম্পে হঠাৎ করে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মাত্রা বেড়ে গেছে। সংক্রমণের বিস্তার রোধে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। সীমান্ত দিয়ে বৈধপথে দেশে ফেরাদের কোয়ারেন্টাইন করার পরও সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে সংক্রমণ দ্রুত বাড়ছে।
বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে অবৈধ পথে মানুষের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে দেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের (আরআরআরসি) অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ শামসুদ দোজা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'গত ৩-৪ দিন ধরে হঠাৎ করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে গেছে। টানা দুই দিন ৪৫ জন রোগী শনাক্ত হওয়ায় সতর্কতার অংশ হিসেবে ৫টি ক্যাম্পে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। ভাইরাসের সংক্রমণ কমাতে চিকিৎসা ও খাদ্যসহ জরুরি প্রয়োজন ছাড়া সব ধরনের চলাচলে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে'।
এখন পর্যন্ত ৪২ হাজার রোহিঙ্গার কোভিড টেস্ট করে ৯০৮ জন কোভিড পজেটিভ শনাক্ত হয়েছে আর মারা গেছেন ১৩ জন। ১৪ মে থেকে ২০ মে পর্যন্ত গত এক সপ্তাহে ক্যাম্পগুলোতে করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে ১৬৫ জন। আর ১৯ ও ২০ মে পরপর দুদিন ৪৫ জন করে রোহিঙ্গা করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এতে উদ্বেগ বেড়েছে।
কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. মোঃ মাহবুবুর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এখন পজেটিভিটি রেট প্রায় ১৫%, আগে যা ১%-২% ছিল। আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি সংক্রমণ যাতে না বাড়ে। কক্সবাজারের পজেটিভিটি রেটও ১০% বেশি, যা ন্যাশনাল পজেটিভিটি রেটের তুলনায় বেশি। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে কাজ করা হচ্ছে'।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় বাংলাদেশে আরও ৩৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত এক বছরেরও বেশি সময়জুড়ে প্রাণঘাতি এই ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ১২ হাজার ছাড়িয়েছে।
মারাত্মক সংক্রামক এই ভাইরাসটি গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত হয়েছে দেশের আরও ১ হাজার ২৮ জনের দেহে। মহামারি শুরুর পর থেকে সব মিলিয়ে এই শনাক্তের সংখ্যা পৌঁছেছে ৭ লাখ ৮৭ হাজার ৭২৬ জনে।
গত ২৪ ঘণ্টায় ১২ হাজার ২৩০টি কোভিড পরীক্ষার বিপরীতে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়েছে শতকরা ৮ দশমিক ৪১ জনের মধ্যে।
জাতীয় পর্যায়ে করোনাভাইরাসের পজেটিভিটি রেট ৮% হলেও সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জের পজেটিভিটি রেট ৫০%। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতিদিন চাঁপাইনবাবগঞ্জের করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. সাইফুল ফেরদৌস টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের হাসপাতালে প্রতিদিন কোভিড রোগী বাড়ছে, আর অধিকাংশ রোগী চাঁপাইনবাবগঞ্জের । শনিবার হাসপাতালে ভর্তি ছিল ১৪৬ জন কোভিড রোগী, তার মধ্যে ৭১ জন চাঁপাইনবাবগঞ্জের। তাদের মধ্যে ৫ জন আইসিইউতে রয়েছে'।
ডা. সাইফুল ফেরদৌস বলেন, 'বৈধ পথে সোনা মসজিদ সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে মানুষ আসছে কম। কিন্তু অবৈধ পথে আসছে অনেকেই। সে কারণে চাঁপাইনবাবগঞ্জে সংক্রমণ বাড়ছে বলে আমাদের ধারণা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ দিয়ে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট যদি দেশে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে'।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. জাহিদ নজরুল চৌধুরী বলেন, 'বুধবার চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ভারত ফেরত কোভিড পজেটিভ ৪২ জনের নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআর এ পাঠানো হয়েছে। রিপোর্ট পাওয়া গেলে জানা যাবে ওই রোগীরা ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত কিনা'।
ডা. জাহিদ নজরুল চৌধুরী বলেন, 'গত চারদিনে সোনা মসজিদ সীমান্ত দিয়ে ৪৯ জন ভারত থেকে দেশে এসেছেন তাদের মধ্যে কোভিড পজেটিভ ছিল ১ জন। বৈধপথে যারা দেশে আসছে তাদের আমরা কোয়ারেন্টাইন করছি'।
বাংলাদেশ সরকার গত ২৬ এপ্রিল থেকে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ রোধে ১৪ দিনের জন্য ভারতের সাথে সীমান্ত বন্ধের ঘোষণা দেয়। তবু অনেক বাংলাদেশিই কোভিড-১৯ নেগেটিভ সার্টিফিকেট দেখিয়ে দেশে প্রবেশের অনুমতি পায়। তাদের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছিল।
সীমান্তবর্তী আরেক জেলা যশোরে ২৬ এপ্রিল থেকে ২১ মে সকাল পর্যন্ত ভারত থেকে ফিরেছেন ৩ হাজার ৩১৪ জন বাংলাদেশি। এদের মধ্যে ভারতে গিয়ে করোনা আক্রান্ত হয়ে ফিরেছেন ১৭ জন বাংলাদেশি। আর প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে থাকা অবস্থায় কোভিড পজেটিভ হয়েছেন ৪৭ জন। এদের মধ্যে ৬ জনের শরীরে করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে।
চুয়াডাঙ্গার সদর হাসপাতালের করোনা আইসোলেশনে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় বৃহস্পতিবার রাতে ভারতফেরত এক যুবক মারা গেছেন।
চুয়াডাঙ্গার জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম সরকার বলেন, 'শুক্রবার পর্যন্ত চুয়াডাঙ্গা সীমান্ত দিয়ে ৪১৫ জন দেশে এসেছে। তাদের মধ্যে ৭ জন কোভিড পজেটিভ, তাদের নমুনা আইইডিসিআর এ পাঠানো হয়েছে'।
দেশের অন্যতম শীর্ষ ভাইরোলজিস্ট এবং কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির সদস্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, 'রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে সংক্রমণ বাড়ার বিষয়টি উদ্বেগজনক। সীমান্ত নজরদারি আরো বাড়াতে হবে। শুধু বৈধপথে নয় অবৈধপথে সীমান্ত দিয়ে যারা দেশে ফিরছে তাদেরও কোয়ারেন্টাইন করতে হবে। সরকার এখন বিভিন্ন উৎস থেকে ভ্যাকসিন কেনার চেষ্টা করছে, সেটি আরো দ্রুত করতে হবে'।
যুক্তরাজ্যের কাছে ১৬ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন চেয়েছে বাংলাদেশ
দেশে করোনা ভ্যাকসিনের সংকট দেখা দেওয়ার পর যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে জরুরি ভিত্তিতে ১৬ লাখ ডোজ টিকা চেয়েছে বাংলাদেশ সরকার।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন যুক্তরাজ্যের টেলিভিশন আইটিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ভ্যাকসিনের বিষয়ে কথা বলেন।
ড. মোমেন বলেন, যুক্তরাজ্য সরকারের কাছে তার বার্তা হলো যে, তাদের আরও আন্তরিক হওয়া উচিত।
'তাদের উচিত কমনওয়েলথ সদস্য দেশগুলোকে সহায়তা করা'।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাজ্যের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে এবং অসংখ্য বাংলাদেশি যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতে অবদান রাখে। সুতরাং যুক্তরাজ্যের এগিয়ে আসা উচিত।
আইটিভির খবরে দেশের ভ্যাকসিন পরিস্থিতিকে 'সংকট' বলে উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, 'আমরা টিকা পেতে মরিয়া।'
চুক্তি অনুযায়ী ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউটের কাছ থেকে ভ্যাকসিন না আসায় ১৪ লাখের বেশি মানুষের দ্বিতীয় ডোজ ভ্যাকসিন পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশকে করোনাভাইরাসের টিকা দিতে যুক্তরাষ্ট্র রাজি হয়েছে বলে সিএনএন টেলিভিশনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, 'আমরা আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মি. ব্লিঙ্কেনকে টিকা চেয়ে চিঠি লিখেছি। আমেরিকা বাংলাদেশকে কিছু ডোজ টিকা দিতে রাজি হয়েছে'।
'তবে সমস্যা হলো মার্কিন খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) এই অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনের রপ্তানি অনুমোদন করতে অনেক সময় নিচ্ছে'।
তবে যেহেতু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই ভ্যাকসিন ইতোমধ্যেই অনুমোদন করেছে, তাই এফডিএ এটি অনুমোদন না করলেও, আমেরিকা যদি টিকার চালান পাঠাতে রাজি হয়, বাংলাদেশ অবিলম্বে তা নিতে রাজি আছে, বলে সিএনএন নিউজ চ্যানেলকে দেয়া লাইভ এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন।
এছাড়া চীন ও রাশিয়ার ভ্যাকসিন পেতে চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। এরইমধ্যে চীন উপহারের ৫ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন বাংলাদেশকে দিয়েছে। আরো ছয় লাখ ডোজ ভ্যাকসিন বাংলাদেশকে উপহার দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে চীন।