লকডাউনে ১.২৫ কোটি পরিবারকে খাদ্য সহায়তা দেবে সরকার
কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ প্রতিরোধে চলমান লকডাউনে ১.২৫ কোটি পরিবারকে খাদ্য সহায়তা দেবে সরকার। ১৪ এপ্রিল থেকে ঘোষিত এক সপ্তাহের লকডাউন পরের সপ্তাহ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রয়োজন হলে 'মানবিক খাদ্য সহায়তা' হিসেবে প্রতি পরিবারকে ১০ কেজি চাল, এক কেজি ডাল, এক লিটার সয়াবিন তেল, এক কেজি লবন ও চার কেজি আলু দেওয়া হবে।
লকডাউন অব্যাহত থাকলে প্রতিমাসে দু'বার করে এই পরিমাণ খাদ্য সহায়তা পাবে পরিবারগুলো। এতে প্রতিমাসে সরকারের ১৭৫০ কোটি টাকা ব্যয় হবে জানিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেছেন, খুব শিগগিরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠেয় এক সভায় বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে।
তবে রমজান উপলক্ষ্যে সরকারের ভালনারেবল গ্রুপ ফিডিং কার্ডধারী (ভিজিডি) এক কোটি ১০ হাজার পরিবারকে ৪৫০ টাকা করে যে নগদ অর্থ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়, তা রবিবার স্থগিত করা হয়েছে। এজন্য বরাদ্দ ছিল ৪৫০ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এছাড়া, জেলা পর্যায়ে হতদরিদ্রদের আর্থিক সহায়তা দিতে জেনারেল রিলিফ (জিআর) হিসেবে ছাড় করা ১২১ কোটি টাকা বিতরণও স্থগিত করেছে মন্ত্রণালয়।
এনামুর রহমান বলেন, 'লকডাউনে মানবিক খাদ্য সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হওয়ায় ভিজিএফ ও জিআর আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে। এই অর্থ ঈদ-উল ফিতরে নগদ সহায়তা হিসেবে দেওয়া হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে আমাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবেন'।
তিনি বলেন, 'গত বছর লকডাউনের সময় দরিদ্র ও কর্মহীন এক কোটি ২৫ লাখ পরিবারকে আমরা খাদ্য সহায়তা দিয়েছি। ওইসব পরিবারের তালিকা সরকারের কাছে রয়েছে। ১৪ এপ্রিল থেকে ঘোষিত লকডাউনের মেয়াদ দ্বিতীয় সপ্তাহ বাড়ানো হলে এই ১৫ দিনের মধ্যে ওই তালিকাভুক্ত পরিবারগুলো একবার খাদ্য সহায়তা পাবে।
'পরে লকডাউনের মেয়াদ আরও বাড়লে দ্বিতীয়বার খাদ্য সহায়তা দেওয়া হবে। অর্থাৎ, লকডাউন অব্যাহত থাকলে প্রতিমাসে দু'বার করে খাদ্য সহায়তা পাবেন দরিদ্র পরিবারগুলো। সরকারের লক্ষ্য লকডাউনে পাঁচ কোটি দরিদ্র মানুষকে খাদ্য সহায়তা দেওয়া। সে জন্যই এ পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে'- যোগ করেন তিনি।
করোনার সেকেন্ড ওয়েভ প্রতিরোধে গত ৫ এপ্রিল থেকে লকডাউন শুরুর পরই কর্মহীন হয়ে পড়েছে পরিবহন শ্রমিকসহ বিভিন্নখাতে নিয়োজিত অসংখ্য শ্রমজীবী। তাদের জন্য খাদ্য সহায়তা ও নগদ সহায়তা দেওয়ার সুপারিশ করছিলেন অর্থনীতিবিদরা।
রবিবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে অনুষ্ঠিত প্রাক-বাজেট সভায়ও এ বিষয়ে গুরুত্ব দেন অর্থনীতিবিদরা। সভা শেষে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের এ তথ্য জানিয়ে বলেছিলেন, কোভিডকালীন প্রণোদনা ও সহায়তার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজে সিদ্ধান্ত নেন। জনগণের জীবন ও জীবিকার স্বার্থে তিনি প্রয়োজন মনে করলে নিশ্চয়ই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।
চলমান লকডাউনে দরিদ্রদের জন্য খাদ্য সহায়তা দেওয়ার সরকারি পরিকল্পনাকে ইতিবাচক হিসেবে মনে করছেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর ।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, লকডাউনের সময় দরিদ্রদের খাবার যোগান দেওয়া সরকারের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আমরাও এ ব্যাপারে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছি।
গত বছর দেশে করোনা শনাক্ত হওয়ার পর সরকার ঘোষিত ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটিকালীন সময়ে মার্চ-মে সময়ে তিন মাস দরিদ্রদের খাদ্য সহায়তা দিতে ২৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার। ওই সময় দরিদ্র পরিবারগুলোকে খাদ্য সহায়তা হিসেবে চাল, ডাল, লবন, তেল ও আলু বিতরণ করে সরকার। অর্থবিভাগের হিসাব অনুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ওই বরাদ্দের মধ্য থেকে ১০৬৮ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, গত লকডাউনে সারাদেশে ১.২৫ কোটি দরিদ্র ও কর্মহীনদের তালিকা প্রণয়ন করে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনভুক্ত শহরগুলোতে এই খাদ্য সহায়তা বিতরণ করা হয়। তালিকাভুক্ত পরিবারগুলো যেভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে সহায়তা পেয়েছে, এবারও একইভাবে তা বিতরণ করা হবে। দেশজুড়ে বিপুল জনগোষ্ঠীর বাড়িতে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে না বলে জানান তারা।
গত বছর মার্চে দেশে করোনা শনাক্ত হওয়ার পর দরিদ্রদের খাদ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ছয়টি প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ৮০৪৩ কোটি টাকা বরাদ্দ করে সরকার। এগুলোর আওতায় কর্মহীন দরিদ্রদের খাদ্য সহায়তা ছাড়াও ৫০ লাখ কর্মহীন দরিদ্রকে ২৫০০ টাকা করে প্রধানমন্ত্রীর ঈদ উপহার দেওয়া, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বাড়ানো, কর্মহীন শ্রমিকদের তিন মাস ৩০০০ টাকা করে ভাতা দেওয়া, ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিতরণ এবং দরিদ্র বয়স্ক ও বিধবা ভাতাভোগীর সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়।
অর্থবিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এসব কর্মসূচির আওতায় খরচ হয়েছে ৩০০৮ কোটি টাকা। শুধু ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিতরণে বরাদ্দের ৭৭০ কোটি টাকার পুরোটা ব্যয় হয়েছে।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়াতে বরাদ্দ থাকা ৮১৫ কোটি টাকার মধ্যে ২৩ কোটি টাকা, ৫০ লাখ পরিবারকে প্রধানমন্ত্রীর ঈদ উপহারের জন্য বরাদ্দ দেওয়া ১২৫৮ কোটি টাকার মধ্যে ৮৮০ কোটি টাকা; তৈরি পোশাক, চামড়া ও পাদুকা শিল্পের বেকার শ্রমিকদের ভাতা প্রদান তহবিলের ১৫০০ কোটি টাকার মধ্যে ৫ কোটি টাকা এবং দরিদ্র বয়স্ক ও বিধবা ভাতাভোগীর সংখ্যা বাড়াতে বরাদ্দ দেওয়া ১২০০ কোটি টাকার মধ্যে ২৬২ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।