শ্রমিক অসন্তোষে ক্ষতিগ্রস্ত কারখানাগুলোকে সহায়তা করবে সরকার, কমিটি গঠন
তৈরি পোশাক (আরএমজি) ও নন-আরএমজি খাতে সংকটে থাকা, বিশেষ করে বিদ্যমান শ্রম অসন্তোষের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক বিষয় পর্যালোচনা করে সংকট থেকে উত্তরণে সহায়তার জন্য একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়েছে।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ২৭ অক্টোবরের অফিস আদেশ অনুসারে, ১০-সদস্যের আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটিকে এসব প্রতিষ্ঠানের তথ্য সংগ্রহ এবং প্রোফাইলিং বিষয়ে পর্যালোচনার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
এসব কারখানার সমস্যা সমাধানের সম্ভাব্য রূপরেখাসহ কমিটিকে এক সপ্তাহের মধ্যে মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
ডিপার্টমেন্ট অব ইন্সপেকশন ফর ফ্যাক্টরিজ অ্যান্ড এস্টাবলিশমেন্ট-এর অ্যাডিশনাল ইন্সপেক্টর জেনারেল আরিফ আহমেদ খানকে আহ্বায়ক করে গঠিত কমিটিতে অর্থ বিভাগ, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, শিল্প পুলিশ, বিজিএমইএ, উদ্যোক্তা এবং শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধিরা সদস্য হিসেবে রয়েছেন।
আরিফ আহমেদ খান টিবিএসকে বলেন, 'প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষমতা রয়েছে এ কমিটির। এটি ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে।'
জেনেভা থেকে বুধবার হোয়াটসঅ্যাপে শ্রম ও কর্মসংস্থান সচিব এএইচএম শফিকুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, 'শ্রমিকদের বকেয়া বেতন-ভাতাসহ সার্ভিস বেনিফিট পরিশোধের ক্ষেত্রে বাধা চিহ্নিত করে সুপারিশসহ সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দেবে কমিটি।'
'এ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী কারখানাগুলোর সংকট উত্তরণে সরকার পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে,' জানান শ্রম সচিব।
হাসিনার পতনের পালিয়ে গেছেন অনেক মালিক, বন্ধ কারখানা
৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর অনেক কারখানার মালিক তাদের ব্যবসা বন্ধ করে পালিয়ে যান। অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়।
অনেক কারখানা এখনও শ্রমিকদের আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের বেতন পরিশোধ করতে পারেনি। যার ফলে পোশাক খাতে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। আশুলিয়া, সাভার, টঙ্গী ও গাজীপুরে বেশকিছু কারখানা এখনও বন্ধ রয়েছে।
বিজিএমইএ-এর ৩০ অক্টোবরের তথ্য অনুযায়ী, দুই হাজার ১১৯টি কারখানার মধ্যে চালু কারখানার সংখ্যা দুই হাজার ১০৭টি। ১২টি কারখানা সাময়িক বন্ধ বা শ্রমিকেরা ছুটিতে রয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসের বেতন এখনও পরিশোধ করেনি ২১টি কারখানা, এবং আগস্টের বেতন বকেয়া রয়েছে দুটি কারখানার।
আশুলিয়া এলাকার বন্ধ ও বেতন বকেয়া থাকা কারখানাগুলোর মধ্যে রয়েছে আনজুমান ডিজাইনার্স লিমিটেড, ডিআইপিএস অ্যাপারেলস লিমিটেড, ও জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশন লিমিটেড। সাভার এলাকায় বন্ধ কারখানার মধ্যে রয়েছে শামস স্টাইলস লিমিটেড, দ্য সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড, কাজীপুর ফ্যাশন লিমিটেড, ও স্ট্যান্ডার্ড স্টিচেস লিমিটেড।
এছাড়া, জিরানী, চন্দ্রা, টঙ্গী, বোর্ডবাজার ও মিরপুরের কচুক্ষেত এলাকায় কয়েকটি কারখানা এখনও বন্ধ রয়েছে।
বিশেষ করে গত মাসে কারখানাগুলোর পরিস্থিতি বেশি খারাপ ছিল। ব্যাপক অস্থিরতার কারণে অনেক কারখানা কয়েক দিনের জন্য কার্যক্রম বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছিল।
শ্রমিক অসন্তোষ ও কারখানা বন্ধ থাকার কারণে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ অর্ডার বাতিল হয়ে গেছে বলে গত মাসে জানিয়েছেন শ্রম উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।
স্কয়ার গ্রুপের সিইও তপন চৌধুরী গত ৯ অক্টোবর সাংবাদিকদের জানান, শ্রম অসন্তোষের কারণে তাদের কোম্পানির ক্রয়াদেশ কমে গেছে এবং বিদেশি ক্রেতারা কিছু অর্ডার অন্য দেশে স্থানান্তর করেছেন।
বিজিএমইএ প্রশাসনিক সহায়তা দলের সদস্য আসিফ আশরাফ টিবিএসকে বলেন, 'বর্তমানে ৯৯.৯১ শতাংশ কারখানা চালু আছে, মাত্র ১০ থেকে ১২টি কারখানা বন্ধ রয়েছে। বর্তমান কমিটির উদ্দেশ্য হলো কিছু কারখানা কেন চালু হচ্ছে না বা সংকটে আছে তা নির্ধারণ করা।'
তিনি আরও বলেন, 'এসব সমস্যা স্থায়ী নয়। আমরা এ পরিস্থিতি থেকে শীঘ্রই বেরিয়ে আসার ব্যাপারে আশাবাদী।'
স্পষ্ট চ্যালেঞ্জ
আরএমজি সেক্টরের এসব চ্যালেঞ্জ স্পষ্ট হলেও নন-আরএমজিখাতে কতগুলো কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ, বেতন-ভাতা বকেয়া বা বন্ধ হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে, সে বিষয়ে কোনো তথ্য জানা যায়নি।
গত দুই মাসে অগ্নিসংযোগ এবং ভাঙচুরের ঘটনায় আরএমজি এবং নন-আরএমজি উভয় খাতের কারখানা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গাজী গোলাম দস্তগীরের মালিকানাধীন গাজী গ্রুপের প্রতিষ্ঠান গাজী টায়ার ফ্যাক্টরি কয়েক দফা আগুনে পুড়ে গেছে এবং সেখানে লুটপাট হয়েছে। কারখানাটি এখন পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে।
বকেয়া বেতন ভাতার দাবিতে সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপের তৈরি পোশাক কারখানায়ও শ্রমিকেরা গত ১১ সেপ্টেম্বর আগুন দিয়েছে।
ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) প্রশাসক হাফিজুর রহমান টিবিএসকে বলেন, শ্রমিক অসন্তোষ এবং ভাঙচুরের ফলে আর্থিক ক্ষতির কারণ দেখিয়ে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এফবিসিসিআই-এর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। তারা সরকারের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য চাইছে এবং তাদের ব্যাংক ঋণ পরিশোধে নমনীয়তার অনুরোধ করেছে।
তিনি উল্লেখ করেন, এফবিসিসিআই বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিবেচনার জন্য সুপারিশসহ এসব আবেদন পাঠিয়েছে।
তবে, এফবিসিসিআই প্রশাসক আবেদন করা কোম্পানি বা মোট আর্থিক ক্ষতির হিসাব তাৎক্ষণিকভাবে দিতে পারেননি।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল ও কমিটির সদস্য মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান টিবিএসকে জানান, 'কত সংখ্যক কারখানা বেতন-ভাতা দিতে পারছে না, এ বিষয়ে পরিপূর্ণ তথ্য এখনো আমাদের হাতে নেই। আমরা মাঠ পর্যায় থেকে এসব তথ্য সংগ্রহ করছি।'
তবে তিনি আরও বলেন, এ ধরনের কারখানা নিরূপণ করাও সহজ নয়। আজ যে কারখানা সমস্যাগ্রস্ত, দুসপ্তাহ পর সেটি হয়তো আর সমস্যায় থাকবে না, কিন্তু নতুন কোনো কারখানা সমস্যায় পড়তে পারে।
তিনি জানান, 'কমিটি গঠনের পর ইতোমধ্যে দুটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে। এছাড়া সমস্যাগ্রস্ত দুটি কারখানার সঙ্গেও কথা বলা হয়েছে।'
ডিপার্টমেন্ট অব ইন্সপেকশন ফর ফ্যাক্টরিজ অ্যান্ড এস্টাবলিশমেন্টস-এর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, শিল্প মালিকেরা কমিটি গঠনের বিষয়টি জানতে পারলে আর্থিক সুবিধা পাওয়ার আশায় অনেকেই নিজেদের আর্থিক সংকটের তথ্য জানাতে আসতে পারে, এমন আশঙ্কায় কমিটি অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে কাজ শুরু করেছে।
পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন ব্যবসায়ী নেতারা
সরকারের এ পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়ে ব্যবসায়ী নেতারা বলেছেন, এসব কারখানা মালিকদের সহায়তা করার পাশাপাশি যেন কোনো ব্যবসায়ী অযথা রাজনৈতিক হয়রানি বা মামলার শিকার না হন, সেদিকেও সরকারকে মনোযোগী হতে হবে।
এছাড়া, কমিটিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধির উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তার ওপরও গুরুত্ব দেন তারা।
বেঙ্গল গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ-এর ভাইস চেয়ারম্যান মো. জসিম উদ্দিন টিবিএসকে জানান, '৫ আগস্টের পর বিভিন্ন কারণে অনেক কারখানা বন্ধ হয়েছে এবং অনেক কারখানা বন্ধ হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে। সরকার কারখানাগুলোর সমস্যা চিহ্নিত করে আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে সেগুলো সচল রাখতে সহায়তা করলে কর্মসংস্থান, উৎপাদন ও রপ্তানি সুরক্ষিত থাকবে।'
তিনি বলেন, 'সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা নিঃসন্দেহে ভালো। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণেও অনেক কারখানা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এসব কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় সেগুলো ঋণের কিস্তি সময়মতো পরিশোধ করতে পারছে না। ফলে কারখানাগুলো খেলাপি হয়ে যাচ্ছে।'