শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ভর্তির হার কমে যাচ্ছে
রাজধানীর মিরপুর সিদ্ধান্ত হাই স্কুলে গত বছর পঞ্চম শ্রেণিতে ২৪০ জন শিক্ষার্থী ছিল। তবে এবছর তাদের মাত্র ১৪৪ জন নতুন শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে।
সব শিক্ষার্থীকে পুনরায় ক্লাসে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে বিদ্যালয়টির প্রশাসন, তবে শিক্ষার্থীদের অনেকেই ইতোমধ্যে বিভিন্ন জায়গায় কাজ শুরু করেছে, এবং ক্লাসে ফিরে আসতে বা অন্য কোথাও ভর্তি হতেও তারা ইচ্ছুক নয়।
বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম রনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-কে জানান, স্কুল খুলতে দেরি হওয়ায় বিদ্যমান শিক্ষার্থীদের নতুন শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
"অনেক অভিভাবক স্কুল খোলার পর তাদের সন্তানদের ভর্তি করানোর চিন্তা করছেন। তবে অনেকেই তাদের সন্তানদের এবছরও স্কুলে পাঠাতে চান না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বেশ কিছু শিক্ষার্থী পরিবারকে সাহায্য করতে কাজ করা শুরু করেছে," বলেন তিনি।
নোয়াখালীর কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার সিরাজপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কামরুল ইসলাম রাশেদ জানান, গত বছর প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে তার বিদ্যালয়ে ৩৯ জন শিক্ষার্থী ছিল। তবে তাদের মধ্যে নয়জনই প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়নি।
"শুধু তাই নয়, প্রতি শ্রেণিতেই গড়ে ছয়- সাত জন শিক্ষার্থী হারিয়েছি। তারা নতুন শ্রেণিতে ভর্তি হয়নি, নতুন বইও নিতে আসেনি।"
নতুন শ্রেণিতে ভর্তির ক্ষেত্রে এই দুটি বিদ্যালয়ের মতোই চিত্র দেশের অন্যান্য বিদ্যালয়গুলোতে। কিছু বিদ্যালয়ের অবস্থা আরও শোচনীয়।
শিক্ষা বিশেষজ্ঞ, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ও শিক্ষকদের মতে, শিক্ষার্থীদের পুনরায় ক্লাসে ফিরিয়ে আনতে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়া হলে প্রাক-প্রাথমিক ও ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ভর্তিতে সরকার যে সাফল্য পেয়েছিল তা হুমকির মুখে পড়বে।
কোভিড-১৯ এর প্রভাবে বাংলাদেশের বেশিরভাগ পরিবার আর্থিক আর্থিক সংকটের মুখে পড়েছে, ফলে অনেক পরিবারই তাদের সন্তানদের কাজ করতে পাঠাতে পারেন, বাল্যবিবাহের হারও বেড়ে যেতে পারে।
প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের ভর্তির নেট হার ও ঝরে পড়ার হার ৯৭ শতাংশ ও ১৮ শতাংশ। মাধ্যমিক পর্যায়ে এ হার ৫৩ শতাংশ ও ৩৭ শতাংশ।
বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) সাম্প্রতিক তথ্যানুযায়ী, ৪৭ শতাংশ শিক্ষার্থীদের অভিভাবকের পেশা কৃষিকাজ, ১৯ শতাংশ শ্রমজীবী, ৮ শতাংশ ক্ষুদে ব্যবসায়ী ও ৫ শতাংশ কুমোর, মৎস্যজীবী ও অন্যান্য পেশার মানুষ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. সিদ্দিকুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-কে জানান, অনেক পরিবার আর্থিক সংকটের কারণে সন্তানদের স্কুলে না পাঠানোয় শিক্ষার্থী ভর্তির হার কমে যেতে পারে। অনেক শিক্ষার্থী, বিশেষত দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা ইতোমধ্যেই পড়াশোনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।
"শিক্ষার্থীদের পুনরায় ক্লাসে ফিরিয়ে আনতে শিক্ষক, অভিভাবক ও বিদ্যালয় প্রশাসনের একত্রে কাজ করতে হবে। যেসব শিক্ষার্থীরা স্কুলে ভর্তি হয়নি তাদের তালিকা তৈরি করে ক্লাসে ফিরিয়ে আনতে জেলা ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা কাজ করতে পারেন।"
শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরিয়ে আনতে সরকার বিশেষ অনুদান বরাদ্দ দিতে পারে ,বলেন তিনি।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদ জানান, সরকার প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের ভর্তিতে সফলতা পেলেও, যথাযথ পরিকল্পনার শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত হয়নি।
"বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই গত বছরের মার্চ থেকে পড়াশোনা থেকে বিচ্ছিন্ন। আমরা এনিয়ে কথা বলেছি, শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরিয়ে আনতে কর্তৃপক্ষকে কাছে তহবিল গঠনের অনুরোধ করেছি," বলেন তিনি।
"উপজেলা পর্যায়ে ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য সরকারকে কমিটি গঠনের জন্য জোর দিয়েছি, তবে তারা কর্ণপাত করেননি। ফলস্বরূপ, বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থী নতুন শ্রেণিতে ভর্তি হয়নি।" যোগ করেন তিনি।
দাপ্তরিক হিসাব অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি হয়েছে। প্রতি বছর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি দেওয়ার জন্য সরকার এক হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে। গত বছরই একাজে এক হাজার ৫৫০ কোটি টাকা ব্যয় করে সরকার। ৬৭ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মাসে জনপ্রতি ১০০ টাকা পায়, কিছু বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির প্রকল্পের আওতায় বিনামূল্যে দুপুরের খাবার পায়। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ভর্তির হার ৯৭ শতাংশে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছে সরকার।
তবে শিক্ষার্থী ভর্তির হার কমে যাওয়ায় এ অর্জন ম্লান হওয়ার পথে। ২০১৯ সালে প্রকাশিত বিশ্ব ব্যাংকের 'অ্যান আরলি-ওয়ার্নিং ইন্ডিকেটর ফর দ্য হিউম্যান ক্যাপিটাল প্রজেক্ট' শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর প্রতিজন শিক্ষার্থীর পেছনে মাত্র ২৪৯ ডলার (ক্রয়ক্ষমতা সমতা) ব্যয় করা হয়- দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে এ হার অত্যন্ত কম, সর্বনিম্ন অবস্থানে থাকা আফগানিস্তানের পরই বাংলাদেশের অবস্থান।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, শ্রীলঙ্কা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতি শিক্ষার্থীর পেছনে এক হাজার ৪৭৪ ডলার ব্যয় করে, ভারত ব্যয় করে ৬২৪ ডলার; যা বাংলাদেশের চেয়ে তিনগুণ। অন্যদিকে পাকিস্তান এক্ষেত্রে ব্যয় করে ৪৬৭ ডলার।
প্রাথমিক শিক্ষায় স্বল্প বিনিয়োগের কারণে হিউম্যান ক্যাপিটাল ইনডেক্সে বাংলাদেশ পেয়েছে ০.৪৮ পয়েন্ট, শ্রীলঙ্কা পেয়েছে ০.৫৮ পয়েন্ট।
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মিজানুর রহমান সরকার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-কে জানান, আর্থিক সংকটের কারণে কার্যক্রম পরিচালনা করতে না পারায় বেশিরভাগ বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেছে।
"ফলস্বরূপ কিন্ডারগার্টেনের মাত্র ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী নতুন বছরের বই নিয়েছে।" বলেন তিনি।
সরকারের প্রতি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার আহ্বান
শিক্ষা খাত্যে কাজ করছে এমন অনেকগুলো বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা পুনরায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের খুলে দেওয়ার ব্যাপারে জোর দিয়েছে। কোভিড-১৯ এর কারণে দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় পড়াশোনায় ঘাটতির পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও এর প্রভাব পড়েছে বলে জানিয়েছে সংস্থাগুলো।
এর ফলে শিক্ষার্থীদের ভর্তির হার কমে যেতে পারে এবং অনেক শিক্ষার্থীই ঝরে পড়তে পারে বলে জানিয়েছে সংস্থাগুলো।
মাসব্যাপী ভর্তি কার্যক্রম, ভর্তির আগেই অপরিশোধিত উপবৃত্তি প্রদান ও অভিভাবকদের সম্পৃক্ত করতে পুনরায় স্কুল খুলে দেওয়ার ব্যাপারে সরকারকে আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাগুলো।
শারীরিকভাবে অক্ষম শিক্ষার্থীসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের সহায়তা প্রদান, স্কুল ফিডিং কর্মসূচির সম্প্রসারণ, নারী শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফিরিয়ে আনতে পৃথক সচেতনতা ক্যাম্পেইন চালানো এবং বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রমের ঝুঁকি সম্পর্কে পরিবারকে সচেতন করে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা প্রচারণার মতো পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাগুলো।