শিশু কোভিড-১৯ রোগীদের ৬০% উপসর্গহীন
শিশু হাসপাতালে কোভিড-১৯ পজিটিভ শিশু বাড়ছে। তবে আক্রান্তদের মধ্যে ৬০ শতাংশের বেশি উপসর্গহীন। জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্টের মত সাধারণ উপসর্গহীন শিশুরাই সার্জারি বা অন্য কোন চিকিৎসা নিতে এসে কোভিড-১৯ টেস্টে পজিটিভ শনাক্ত হচ্ছে। শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো হওয়ায় তাদের মধ্যে মৃত্যুর হার কম হলেও তাদের থেকে অন্যদের করোনাভাইরাস ছড়ানোর ঝুঁকি রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত হাসপাতালের ইনডোর ও আউটডোর মিলিয়ে কোভিড-১৯ পজিটিভ রোগী শনাক্ত হয়েছে ৫৮৯ জন শিশু। এর মধ্যে মারা গেছে ২০ শিশু। কোভিড-১৯ পজিটিভ এ শিশুদের মধ্যে প্রায় ৩৫০ জন ৬০% এর বেশি উপসর্গহীন।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. কিংকর ঘোষ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সার্জারি বা নন-কোভিড অন্য কোন চিকিৎসা নিতে আসা শিশুদের কোভিড-১৯ টেস্ট করে পজিটিভ পাওয়া যাচ্ছে। ওই শিশুদের মধ্যে কোভিড-১৯ এর কোন লক্ষণ থাকছে না। আমাদের হাসপাতালে ২১ নভেম্বর একদিনে সর্বোচ্চ ২৫ জন শিশু কোভিড-১৯ পজিটিভ হয়। তার মধ্যে ১৮ জনই ছিলো অ্যাসিমটোমেটিক।"
তিনি বলেন, "এখন শীতকালীন ঠান্ডা, নিউমোনিয়া নিয়ে অনেক শিশু রোগী হাসপাতালে আসছে তাদের কোভিড-১৯ এর লক্ষণের সঙ্গে আলাদা করা যাচ্ছে না। ঠান্ডা লাগা, নিউমোনিয়ার শিশুদের টেস্ট করার পর কোভিড-১৯ পজিটিভ পাওয়া যাচ্ছে। এতে ওই শিশুর নিউমোনিয়া বা সার্জারির যে রোগের কারণে হাসপাতালে আসছে তার চিকিৎসা শুরু হতে দেরি হচ্ছে। শিশুরা কোভিড-১৯ পজিটিভ হওয়ার পর ডিজিজ বার্ডেন আরো বাড়ছে।"
সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, করোনায় আক্রান্ত শিশুদের এক-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ৩৬ শতাংশই উপসর্গবিহীন।
কানাডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণার জন্য গবেষক দলে গত এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত করোনা পজিটিভ আসা প্রায় ২৫০০ শিশুর ওপর নজর রাখে।
এদের প্রত্যেকেই সর্বনিম্ন পাঁচ বছরের শিশু এবং প্রত্যেককেই কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং এর মাধ্যমে উপসর্গ থাকা কিংবা না থাকা বিবেচনা বাদ দিয়েই করোনা পরীক্ষা করা হয়।
এই শিশুদের মধ্যে ১৯৮৭ জনের জনের করোনা পজিটিভ আসে এবং ৪৭৬ জনের নেগেটিভ আসে।
পজিটিভি আসা শিশুদের মধ্যে ৭১৪ জন অর্থাৎ ৩৫ দশমিক ৯ শতাংশের দেহেই করোনার কোনো উপসর্গের দেখা মেলেনি।
পরীক্ষা করা শিশুদের তেমন কারও মধ্যে করোনার সাধারণ উপসর্গ- কাশি, জ্বর বা শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যার লক্ষণ দেখা যায়নি। তবে ফলাফল পজিটিভ আসা শিশুদের কাশি এবং সর্দি হতে দেখা গেছে। এই দুই উপসর্গ নেগেটিভ আসা শিশুদের মধ্যেও দেখা গেছে।
তবে করোনায় আক্রান্ত হলে বিতৃষ্ণাবোধ এবং স্বাদ চলে যাওয়ার বিষয়টি শিশুদের ক্ষেত্রে প্রায় সাত গুণ পর্যন্ত কাজ করতে পারে বলে ওই গবেষণায় উঠে এসেছে।
ইউনিভার্সিটি অব আলবাট্রার মেডিসিনের অধ্যাপক ডা. ফিনলে ম্যাকঅ্যালিস্টার বলেন, 'জনস্বাস্থ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে উদ্বেগটি হল, কমিউনিটিগুলোর মধ্যেই প্রচুর কোভিড-১৯ আক্রান্ত রয়েছে যা মানুষজন বুঝতেও পারে না।'
তিনি বলেন, 'অবশ্যই, বাচ্চারা বিভিন্ন ভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছে, তাই কোভিড-নির্দিষ্ট লক্ষণগুলি যেমন স্বাদ এবং গন্ধ হ্রাস, মাথা ব্যথা, জ্বর এবং বমি বমি ভাব দেখা যেতে পারে। নাকের স্রাব, কাশি এবং গলা ব্যথার উপসর্গ কম হয়।'
ম্যাকঅ্যালিস্টার বলেন, কেউ যদি অসুস্থ বোধ করেন তবে তাদের বাড়িতে থাকতে হবে এবং যারা ভাল বোধ করেন তাদেরও সামাজিক দূরত্ব, হাত ধোওয়া এবং মাস্ক পরার মতো স্বাস্থ্যবিধিগুলো মেনে চলা উচিত।
বিখ্যাৎ ভাইরোলজিস্ট এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়য়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, শিশুদের কোভিড-১৯ পজিটিভ হওয়ার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। শিশুরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উপসর্গহীন হওয়ায়, তাদের থেকে অন্যদের মধ্যে ভাইরাস ছড়ায়। সেজন্য শিশুদের সাবধানে রাখতে হবে।
তিনি বলেন, শিশুরা বাড়ির বাইরে না বের হলেও পরিবারের অন্য সদস্যদের মাধ্যমে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে। শিশুরা কোভিড-১৯ পজিটিভ হলে, তাদের আশেপাশের সবার কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং ঠিকমত করতে হবে।
শিশু হাসপাতালে কোভিড-১৯ পজিটিভ শিশুদের মধ্যে শূণ্য থেকে ২৮ দিন বয়সী ১৪%, ১ মাস থেকে ১ বছর বয়সী ৩০%, ১-৫ বছর বয়সী ২৮%, ৫-১০ বছর বয়সী ১৯% ও১০ বছর বয়সের উপরে ৯% রোগী।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে এখন পর্যন্ত ৩% শিশু কোভিড-১৯ পজিটিভ। এখন পর্যন্ত শূণ্য থেকে ১০ বছরের মধ্যে এখন পর্যন্ত ৩২ শিশু মারা গেছে। ১১-২০ বছরের মধ্যে মারা গেছে ৫৪ জন। শতকরা হিসাবে যা ০.৪৮% ও ০.৮১ %.
কিংকর ঘোষ বলেন, শীতের সময় নিউমোনিয়া, ঠান্ডা জ্বরসহ শিশুদের বিভিন্ন ধরণের রোগ বাড়ে, এ বছর তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে করোনাভাইরাস। এবার শিশুদের বিষয়ে অভিভাবকেদের আরো সচেতন হতে হবে। শিশুদের সুরক্ষিত রাখতে পরিবারের সদস্যদের বাইরে বের হলে মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে।