শীতে কোভিড সংক্রমণ বাড়লেও জেলা হাসপাতালে পর্যাপ্ত আইসিইউ শয্যা নেই
কোভিড সংক্রমণ বাড়ার পাশাপাশি সারা দেশের হাসপাতালগুলোতে কোভিড-১৯ আক্রান্ত গুরুতর অসুস্থ রোগীর চাপ বাড়ছে। তবে, জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে এ ধরনের রোগীকে সেবা দেওয়ার জন্য আইসিইউ শয্যা এবং ডাক্তারসহ দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী নেই। একারণে সঙ্কটাপন্ন রোগীরদের ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু এসব হাসপাতালেও এখন আইসিইউ বেড খালি পাওয়া যাচ্ছে না।
কোভিড-১৯ অতিমারী মোকাবিলা এবং সঙ্কটাপন্ন রোগীদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী আইসিইউ সুবিধাসহ জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত করতে দুদফা নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই নির্দেশনা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।
কোভিডের জন্য সারাদেশে হাসপাতালগুলোতে যেসব আইসিইউ বেড নির্ধারণ করা হয়েছে, সেগুলো খালি না থাকায় গুরুতর অসুস্থ নতুন রোগীদের অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ হচ্ছে। গত রোববার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, ঢাকায় কোভিড চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত তিনটি হাসপাতালের কোনটিতেই আইসিইউ শয্যা খালি নেই।
এরকম একটি হাসপাতালের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জরুরি বিভাগের বিশেষজ্ঞ বলেন, 'আইসিউতে বেড খালি হওয়ার উপায় হলো রোগীর মৃত্যু অথবা রোগীর অবস্থার উন্নতি হওয়া। বেশিরভাগ দিনই কোন বেড খালি থাকে না। এখন একটি আইসিইউ বেডের বিপরীতে ১৫-১৬ জন রোগী ভর্তির অপেক্ষায় থাকে। ক্রিটিক্যাল রোগীর চাপ প্রতিদিনই বাড়ছে।'
এব্যাপারে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট ডা. আসাদুল মজিদ নোমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, আইসিইউয়ের জন্য অপেক্ষমান রোগীর লাইন বড় হচ্ছে। কিন্তু কোনো শয্যা খালি নাই।
ঢাকা মেডিকেলে আশেপাশের জেলাগুলো থেকে প্রচুর সঙ্কটাপন্ন রোগী আসছে বলেও জানান তিনি। কিন্তু শয্যার অভাবে তাদেরকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেয়া যাচ্ছে না।
প্রধানমন্ত্রী জুন মাসে একবার এবং অক্টোবরে শুরুর দিকে আরেকবার জেলা হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ স্থাপন এবং অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করাসহ কোভিড চিকিৎসার পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছিলেন।
কিন্তু, বাস্তবতা হচ্ছে কোভিডের চিকিৎসায় বেশিরভাগ জেলা শহরের হাসপাতালে কোনো আইসিইউ বেড নেই। নেই হাই-ফ্লো অক্সিজেন সরবরাহ সুবিধাও।
বিশ্বব্যাংকের কোভিড-১৯ জরুরি প্রতিক্রিয়া এবং মহামারি প্রস্তুতি প্রকল্পটির আওতায় দেশের ৬৪টি জেলায় ৫ বেডের আইসিইউ ইউনিট স্থাপনের কথা। এজন্য মোট বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৩৫ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। প্রতি জেলায় ৫ বেডের আইসিইউ ইউনিটের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২ কোটি ১২ লাখ টাকা।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) সাইদুর রহমান দাবি করেন, জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ ইউনিট স্থাপনের কাজ চলছে। শিগগিরই তা শেষ হবে বলে আমরা আশাবাদী।'
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে কোভিড রোগীদের জন্য সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল মিলে নির্দিষ্ট আইসিইউ শয্যা আছে ৫৭৮টি। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরে আছে ৩১৬টি ও চট্টগ্রাম মহানগরে ৪৩টি শয্যা। বাকি ২১৯টি আছে সারা দেশে, যার সিংহভাগই বিভাগীয় শহরের হাসপাতালে। জেলা পর্যায়ের বেশিরভাগ হাসপাতালেই ডেডিকেটেড আইসিইউ শয্যা নেই।
এব্যাপারে দেশের অন্যতম জীবাণু বিশেষজ্ঞ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটির সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, 'ক্রিটিক্যাল রোগীরা হাসপাতালে এসে যথাযথ চিকিৎসা না পেয়ে মারা যাচ্ছে। বেশিরভাগ সরকারি হাসপাতালে হাই-ফ্লো অক্সিজেন নেই, আইসিইউ বেড নেই। বেড আছে ঢাকাসহ এমন বিভাগীয় শহরগুলোতে এসেও, বেড খালি না থাকায় তারা চিকিৎসা পাচ্ছেন না।'
তিনি বলেন, 'এ অবস্থায় অনেক রোগী মারা যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পরও আইসিইউ ইউনিট স্থাপন করা হয়নি। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাও মানা হচ্ছে না। মৃত্যু কমাতে দ্রুত জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ বেড স্থাপনসহ প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।'
জনবল সংকটের কারণে জেলা পর্যায়ে আইসিইউ শয্যা স্থাপন করা যাচ্ছেনা বলে দাবি করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম বলেন, 'আমাদের কাছে পর্যাপ্ত আইসিইউ বেড ও ভেন্টিলেটর আছে। কিন্তু, দক্ষ জনবলের অভাবে সেগুলো স্থাপন করা যাচ্ছে না। দেশে ডিগ্রিপ্রাপ্ত অ্যানেস্থোলজিস্টও কম। যারা আছে, নিয়োগ প্রক্রিয়ার জটিলতার কারণে তাদের নিয়োগ দিতেও দেরি হচ্ছে।'
তিনি আরো বলেন, 'মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের প্রতিটি জেলা থেকে একজন করে মেডিকেল অফিসার ঢাকায় এনে অ্যানেস্থেশিয়ার ওপর প্রশিক্ষণ দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, যাতে তারাই জেলায় ফিরে গিয়ে আইসিইউ পরিচালনা করতে পারে। আমরা এরকম একটি কর্মসুচিতে হাত দিয়েছি।'
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল এবং ক্লিনিক) ডা. ফরিদ মিয়া বলেন, 'প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা কাজ করছি। এরইমধ্যে দেশের ৫৯টি হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্ল্যান্ট বসিয়েছি। আরো ৬৫টি হাসপাতালে কাজ চলছে।'
জনবল সংকটের বক্তব্য সঠিক নয় উল্লেখ করে বাংলাদেশ অ্যানেস্থোলজিস্ট সোস্যাইটির সভাপতি ডা. দেবব্রত বণিক টিবিএসকে জানান, ডিগ্রি ও প্রশিক্ষণ-প্রাপ্ত এক হাজারের বেশি অ্যানেস্থেশিওলজিস্ট এখন বেসরকারি পর্যায়ে কাজ করছে। এর মধ্যে ৫০০ জনকে জরুরি ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়ে সঙ্কটাপন্ন কোভিড রোগীদের আইসিইউ সেবা দিতে পারে সরকার।
তিনি বলেন, 'গত এপ্রিল মাস থেকে অ্যানেস্থেশিওলজিস্ট নিয়োগ দেয়ার জন্য আমরা সরকারের সাথে আলোচনা করে আসছি। কিন্তু সরকারের তরফে এখনো কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।'