সংরক্ষিত বন ভাগ করতে চায় সরকারি দুই সংস্থা
দেশের সবচেয়ে বড় সংরক্ষিত বনাঞ্চল রামগড়-সীতাকুণ্ডকে হুমকির মুখে ফেলে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন এবং রাস্তা নির্মাণ করতে চায় সরকারের দু’টি সংস্থা। এর মধ্যে সংরক্ষিত বনের ৯ কিলোমিটার ভেদ করে রাস্তা বানাতে চায় সড়ক ও জনপদ (সওজ) বিভাগ। আর বনের ভেতর দিয়ে ১৩ কিলোমিটার বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন করতে চায় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড।
বন বিভাগের আপত্তির পরও বনকে দ্বিখণ্ডিত করে তাদের প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চায় সংস্থা দুটি। এ দুই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ঝুঁকিতে পড়বে সেখানে থাকা দুর্লভ প্রজাতির হাজারো উদ্ভিদ ও বন্যপ্রাণি। কাটা পড়তে পারে ২৫ হাজার গাছ।
নিয়ম অনুযায়ী যে কোনো ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে নিতে হয় পরিবেশ প্রভাব নিরূপন সমীক্ষা। কিন্তু এ দুই প্রকল্প কোনো ধরনের সমীক্ষা ছাড়াই তাদের কাজ এগিয়ে নিতে চাইছে।
বন বিভাগ জানিয়েছে, সংরক্ষিত এ বনের মধ্যে চট্টগ্রাম জেলার সবচেয়ে জীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ এলাকা বারৈয়াঢালা জাতীয় উদ্যান ও হাজারিখিল বন্যপ্রাণি অভয়ারণ্য অবস্থিত। এ ফরেস্টে রয়েছে প্রায় ২৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১২৩ প্রজাতির পাখি, আট প্রজাতির উভচর ও ২৫ প্রজাতির উদ্ভিদ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংরক্ষিত বনের ভেতর দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করা হলে তা এ বনে থাকা জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকি ডেকে আনবে। জীব বৈচিত্র্যের স্বার্থে এ ধরণের প্রকল্প থেকে সরে আসা উচিত।
১৩ কিলোমিটার বন ভাগ করবে বিপিডি, কাটা হবে ১৫ হাজার গাছ
মাতারবাড়ী-মদুনাঘাট-মেঘনাঘাট ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইনের জন্য ১৩ কিলোমিটার বন কাটা হবে। এ জন্য কাটা পড়বে বিভিন্ন প্রজাতির ১৫ হাজারের অধিক গাছ। ৬৩ হেক্টর বনের মধ্যে বিভিন্ন উদ্ভিদসহ রাবার গাছ কাটা পড়লে ক্ষতির মূল্য নিরূপন করা হয়েছে সাড়ে ৭৮ কোটি টাকা।
বিদ্যুৎ বিভাগের সঞ্চালন লাইনের জন্য মিরসরাইয়ের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ৬৩ হেক্টর বনভূমির ওপর দিয়ে যাবে এ বিদ্যুৎ লাইন। এর মধ্যে বন বিভাগের রয়েছে ৪১ দশমিক চার হেক্টর বনভূমি। বাংলাদেশ ফরেস্ট ইন্ডাস্ট্রিজ ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের (বিএফআইডিসি) রাবার বাগান রয়েছে ২১ দশমিক ৬ হেক্টর ভূমিতে। এই বনভূমির আয়তন প্রায় ৭২ বর্গকিলোমিটার।
সঞ্চালন লাইনের দুইদিকে ২৩ মিটার করে মোট ৪৬ মিটার এলাকার গাছপালা কাটা হবে। এ জন্য শুধু উত্তর বন বিভাগের কাটা হবে কাঠ উপযোগী ২২৭টি গাছ, এক হাজার ৪৪০টি বল্লী, এক হাজার ৮৫৯টি চারা, ১২১টি বাঁশঝাড়। এসব গাছের মধ্যে রয়েছে সেগুন, গর্জন, চাপালিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ। এ ছাড়াও রয়েছে জীববৈচিত্র্যের জন্য নির্মিত ২১টি টাওয়ার। টাওয়ার ও গাছের মোট ক্ষতির পরিমাণ ১৭ কোটি ৯১ লাখ ছয় হাজার ১৬৭ টাকা। অন্যদিকে বাংলাদেশ বন শিল্প উন্নয়ন করপোরেশনের দাঁতমারা রাবার বাগানের ২১ দশমিক ৬ হেক্টর ব্যবহার করা হবে এ বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনে। এ রাবার বাগানে রয়েছে উৎপাদনশীল ১১ হাজার ৩৬৮টি রাবার গাছ। এ বাগানেও রয়েছে ১৩টি জীববৈচিত্র্য টাওয়ার। এ বাগানের মোট ক্ষতির পরিমাণ ৬০ কোটি ৫৫ লাখ ৩৮ হাজার ১৬০ টাকা।
তবে এ বিষয়ে বিপিডির উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে কেউ কথা বলতে রাজি হননি।
৯ কিলোমিটার বনের মধ্যে রাস্তা বানাতে চায় সওজ
বনের ভেতর দিয়ে যে ট্র্যাকে রাস্তা বানানো হবে সেট্র্যাকে রয়েছে দেশের বিলুপ্ত প্রায় বৈলাম, কাউগুলা এবং চিপরাশিসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় দশ হাজার গাছ। রাস্তা বানানো হলে এই দশ হাজার গাছ কাটা পড়বে।
চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা বখতেয়ার নূর সিদ্দিকী বলেন, সংরক্ষিত বনের ভেতর দিয়ে রাস্তা ও বিদ্যুৎ সঞ্চালন না করার জন্য আমরা বার বার আপত্তি জানিয়ে আসছি। বনের ভেতর দিয়ে রাস্তা করার জন্য সর্বশেষ আন্তমন্ত্রণালয়ের সভায় যুক্তি তুলে ধরেছি। এর মাধ্যমে জীববৈচিত্র্য যেমন হুমকিতে পড়বে। তেমনি রাস্তা হওয়ার কারণে সংরক্ষিত বনের আর চরিত্র থাকবে না। এখন মন্ত্রণালয় থেকে যে কমিটি করে দেওয়া হয়েছে তার সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করছে রাস্তা হবে কী হবে না।
একই প্রসঙ্গে সড়ক ও জনপদ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী এবং প্রকল্প কর্মকর্তা জুলফিকার আহমেদ বলেন, ২৫ ডিসেম্বর (বুধবার) মন্ত্রণালয় থেকে একটি দল সরেজমিন পরিদর্শন করেছে। তাদের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে বনের ভেতর দিয়ে রাস্তাটি হবে কিনা। যদিও প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হবে আগামী বছরের ডিসেম্বরে।
গাছ কাটার প্রসঙ্গে তিনি দাবি করেন, ‘‘যে ট্র্যাকে সড়ক হচ্ছে সেখানে আগে হাঁটার পথ ছিল। এখানে গাছের পরিমাণ খুবই সামান্য। ফলে গাছ খুব বেশি কাটা হবে না।’’
সড়ক ও জনপদ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, সীতাকুণ্ডের বারৈয়াঢালা ফটিকছড়ির হাজারিখিলের পেলা গাজীর দিঘী পর্যন্ত ২১ কিলোমিটার বাইপাস সড়ক করছে সড়ক ও জনপদ (সওজ) বিভাগ। এরই মধ্যে সড়কটির ১২ কিলোমিটারের কাজ শেষ করে সওজ। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক এবং ফটিকছড়ি-খাগড়াছড়ি হাইওয়ের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের জন্য এ সড়ক নির্মাণ করছে সওজ। সড়কের ২১ কিলোমিটারের মধ্যে নয় কিলোমিটার পড়েছে দেশের অন্যতম সংরক্ষিত বনভূমি রামগড়-সীতাকুন্ড ফরেস্ট মধ্যে। বর্তমানে এই নয় কিলোমিটার সড়ক এবং বারৈয়াঢালা অংশের তিন কিলোমিটার সড়কের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৭২ কোটি টাকা। এরই মধ্যে নতুন করে কার্যাদেশও দেওয়া হয়েছে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করা হবে এ সড়ক।
অন্যদিকে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মধ্য দিয়ে রাস্তা নির্মাণ কিংবা উন্নয়নমূলক কার্যক্রম চালাতে হলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক, কিন্তু মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়াই সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সওজ অধিদপ্তর। সওজ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, ৯ কিলোমিটারের সড়কটি নির্মাণ করা গেলে ঢাকা থেকে পার্বত্য জেলায় যেতে যাত্রীদের ৭০ কিলোমিটার দূরত্ব কমবে। একই সঙ্গে ওই অঞ্চলের জনসাধারণের যোগাযোগ ও পর্যটনের নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে।
অবশ্য সরকারের দুই সংস্থার মধ্যে বিদ্যমান জটিলতা নিরসন করতে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় থেকে সর্বশেষ আন্তমন্ত্রণালয়ের সভায় গত ৬ নভেম্বর ১৩ সদস্যের একটি কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন, বন বিভাগ, সওজসহ কয়েকটি সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত কমিটি সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে সড়কটি নির্মাণের যৌক্তিকতা দেখবে ডিসেম্বরের মধ্যে। একই সঙ্গে সড়কটি নির্মাণ করা হলে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য কতটা হুমকির মধ্যে পড়বে, তা দেখে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেবে। কমিটির প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করবে সড়কটি।
চটগ্রাম সওজ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালের ২৯ জুন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় চট্টগ্রাম জেলার মহাসড়কের যথাযথ মান ও প্রশস্ততা শিরোনামে একটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। ওই প্রকল্পের আওতায় একটি অংশ হচ্ছে বারৈয়াঢালা থেকে হাজারীখিল হয়ে ফটিকছড়ি পর্যন্ত সাড়ে ২৪ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ। এর মধ্যে ৯ কিলোমিটার পড়েছে সংরক্ষিত বনের মধ্যে।
বন বিভাগ থেকে পাওয়া তথ্য মতে, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড ও মিরসরাই উপজেলার মধ্যে দুই হাজার ৯৩৪ হেক্টর বনভূমিতে প্রাকৃতিক সম্পদ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে ২০১০ সালে এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বারৈয়াঢালাকে জাতীয় উদ্যাণ ঘোষণা করে সরকার। অন্যদিকে ফটিকছড়ি উপজেলায় অবস্থিত দুই হাজার ৯০৮ হেক্টরজুড়ে অবস্থিত হাজারীখিল বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয় ২০১৪ সালে। ১৯২৭ সালের সংশোধিত বন আইন এবং ২০১২ সালের বন্য প্রাণী আইনে সংরক্ষিত বনে যেকোনো ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা না করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কেউ করলে সেটি আইনগত অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হবে।
এ প্রসঙ্গে বারৈয়াঢালা ও হাজারিখিল বনাঞ্চল নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামাল হোসেন বলেন, এ বনে রয়েছে দেশের বিরল প্রজাতির সুউচ্চ বৈলাম বৃক্ষ। এ বনের ভেতর দিয়ে রাস্তা বা বিদ্যুৎ লাইন নিয়ে যাওয়া হলে গাছ যেমন কাটা পড়বে তেমনি বিদ্যুৎ লাইনের কারণে মারা যেতে পারে বিভিন্ন ধরনের প্রাণিও। তাছাড়া রাস্তা হলেই আশেপাশে বসতি গড়ে উঠবে দখল হয়ে যাবে বনভূমিও। তাই পরিবেশের স্বার্থে বনাঞ্চল দ্বিখ-িত না করে বিকল্পভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা উচিত।