সফটওয়্যারের ভুল সংশোধন করা যাচ্ছে না, বিপাকে চট্টগ্রামের হাজারো টিকা গ্রহীতা
দেবব্রত রায় দেবু গত ১৮ মার্চ করোনার টিকার (অ্যাস্ট্রাজেনেকা) প্রথম ডোজ গ্রহণ করেন। দ্বিতীয় ডোজ নেন ৭ জুন। সেসময় এন্ট্রি দেওয়ার জন্য তার টিকাকার্ডটি নিয়ে যায় চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
কর্মকর্তাদের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করা হলেও গত তিন মাসেও তিনি সনদ সংগ্রহ করতে পারেননি। বরং ১৮ আগস্ট তাকে আবারও দ্বিতীয় ডোজের টিকা নেওয়ার জন্য এসএসএম পাঠানো হয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে।
বিষয়টি সিভিল সার্জন কার্যালয়ে জানানো হলেও এখন বলা হচ্ছে, এসএমএসের তারিখেই সার্টিফিকেট দেওয়া হবে। কারণ এটি সংশোধন করার কোনো সিস্টেম তাদের হাতে নেই।
শুধু দেবব্রত নয়, চট্টগ্রামের ইলিয়াস নামে আরেক ব্যক্তি ৪ এপ্রিল প্রথম ডোজের টিকা নিয়ে, তারিখ অনুসারে ৭ জুন দ্বিতীয় টিকা নিয়েছেন। কিন্তু এখন ১ সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় ডোজের টিকা নেওয়ার এসএমএস পেয়েছেন ।
দুই টিকা প্রদানের মধ্যকার সময়ের ব্যবধান কমাতে তিনি জেলা সিভিল সার্সন ও স্বাস্থ্য বিভাগে যোগাযোগ করে কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না।
তিনি বলেন, "আমার সার্টিফিকেটটি জরুরী ভিত্তিতে প্রয়োজন। কিন্তু সার্টিফিকেটতো পাচ্ছিইনা, অন্যদিকে টিকা প্রদানের তারিখের মধ্যে থাকছে বড় ধরনের গরমিল।"
এই ধরনের অভিযোগ নিয়ে প্রতিদিন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জনের কার্যালয় ও টিকা কেন্দ্র গুলোতে কয়েকশত মানুষ ভীড় করছেন। সবচেয়ে বিপাকে আছেন বিদেশগামী যাত্রীরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা সিভিল সার্জন ডা. শেখ ফজলে রাব্বি বলেন, "শুরুর দিকে মাত্র একজন ব্যক্তি টিকার ডেটা আপলোড দিতেন, সে কারণে আমরা পিছিয়ে পড়েছি। এখন কয়েকজন সেচ্ছাসেবকের মাধ্যমে এ সমস্যা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চলছে। এসএমএসের ভুল সংশোধন করার বিষয়টি আমাদের হাতে নেই। তাই মানুষের কষ্ট দেখেও আমরা কিছু করতে পারছি না।"
এরকম একটি সমস্যা নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, "আমরা সংশোধন করতে পারছি না, এটি এটুআই-এর হাতে। এমন অসংখ্য সমস্যা আমাদের কাছে আসছে।"
ছয় মাসেও মিলেনি টিকার প্রথম ম্যাসেজ
সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা কামাল উদ্দিন তালুকদার (৬৫) ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে টিকার জন্য রেজিষ্ট্রেশন করান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কেন্দ্রে। কিন্তু গত সাড়ে পাঁচ মাসেও তার টিকাদানের ম্যাসেজ আসেনি।
৭ আগস্ট সারাদেশে পরিচালিত গণটিকা কর্মসূচিতেও কাউন্সিলরদের টোকেন বাণিজ্যের কারণে তিনি টিকা নিতে ব্যর্থ হন। দীর্ঘ সময়েও টিকা নিতে না পেরে এই বয়োবৃদ্ধ মানুষটি নিজের জীবন নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছেন।
কামাল উদ্দিন তালুকদার বলেন, "সুরক্ষা অ্যাপে রেজিস্ট্রেশন করেও মেসেজ আসছে না। নতুন করে রেজিষ্ট্রিশনের চেষ্টাও করেছি; কিন্তু সেটাও হচ্ছে না। এখন আমি টিকাটা কীভাবে পাব?"
মডার্নার জন্য রেজিস্ট্রেশনের পর সিনোফার্ম পাচ্ছেন প্রবাসীরা
১৯ জুন চট্টগ্রামে দ্বিতীয় পর্যায়ে করোনার টিকা কর্মসূচি শুরু হয়। সে সময় জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে জানানো হয় যে, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকার বাসিন্দারা মডার্না ও উপজেলার বাসিন্দারা চীনের তৈরী সিনোফার্মের টিকা পাবেন।
কিন্তু ১২ আগস্ট সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে জানানো হয় মডার্না ও সিনোফার্মের টিকার সরবরাহ না থাকায় জেলায় টিকা কার্যক্রম সাময়িক ভাবে বন্ধ থাকবে। একদিন পর থেকে নগরের বিভিন্ন কেন্দ্রে আবারও টিকা দেওয়া শুরু হলেও মডার্নার পরিবর্তে সিনোফার্মের টিকা দেওয়া হচ্ছে, যা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন নগরবাসী।
নগরীর শমশের পাড়া এলাকার সর্দার মাহবুব আলম বলেন, "কিছুদিনের মধ্যে আমাকে দেশের বাইরে যেতে হবে। তাই মডার্নার টিকা পেতে জেনারেল হাসপাতালে রেজিষ্ট্রেশন করেছিলাম। কিন্তু টিকা নেওয়ার সময় আমাকে সিনোফার্মের টিকা দেওয়া হয়েছে। এতে আমার বিদেশ যাওয়া নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।"
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা সিভিল সার্জন ডা. শেখ ফজলে রাব্বি বলেন, "বিদেশগামী যাত্রীদের জন্য সরকারি কোনো নির্দেশনা নেই। তবে মডার্নার টিকার সংকট থাকায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এলাকায় এখন সিনোফার্মের টিকা দেওয়া হচ্ছে।"
সিভিল সার্জন জানান, চট্টগ্রাম নগরের ১১টি টিকাকেন্দ্র এবং ১৪ উপজেলায় এখন সিনোফার্মের টিকার প্রথম ডোজ দেওয়া হচ্ছে। যারা টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন, তাদের দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হচ্ছে।
অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও মডার্নার টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হচ্ছে। এর আগে চট্টগ্রামে অ্যাস্ট্রাজেনেকার প্রায় ৯ লাখ ১০ হাজার টিকা আসে। মডার্নার আসে প্রায় ৩ লাখ ৮৬ হাজার ৮৮০ ডোজ। ৬ লাখ ১০ হাজার ৪০০ ডোজ টিকা আসে সিনোফার্মের।
টিকা নিয়েও মিলছে না সার্টিফিকেট
ছয়মাস আগে ছুটিতে দেশে ফিরেছিলেন সৌদি প্রবাসী মোহাম্মদ হানিফ (৪৫)। গণটিকার প্রথম দফায় অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ডের দুই ডোজ টিকা গ্রহণ করেন তিনি। কিন্তু টিকা নেওয়ার চার মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো টিকার সার্টিফিকেট পানটি তিনি। এ কারণে তার প্রবাসে ফিরে যাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পরেছে।
আবু হানিফ বলেন, "শুরুতে শুধু টিকা গ্রহণের কাগজ দেখিয়ে সৌদি যাওয়া গেছে। ১লা জুন থেকে টিকা গ্রহণের সার্টিফিকেট ছাড়া সে দেশে প্রবেশ করা যাচ্ছে না। কিন্তু চারমাস চেষ্টা করেও সুরক্ষা অ্যাপস থেকে আমার সার্টিফিকেট পাইনি।"
শুধু প্রবাসী আবু হানিফ নয়, চট্টগ্রামে দুই ডোজ টিকা নিয়েও সার্টিফিকেট পানটি এমন লোকের সংখ্যা অন্তত দুই লাখের বেশি। এ কারণে বিভিন্ন পেশার মানুষ নানা সমস্যা ভোগ করছেন।
সমস্য সমাধানে চেষ্টা চলছে জানিয়ে সিভিল সার্জন বলেন, "বর্তমানে দৈনিক টিকাদানের সংখ্যার তুলনায় নিবন্ধন অনেক বেশি হওয়ায় টিকার এসএমএস পেতে মানুষের দেরি হচ্ছে। নগরের জেনারেল হাসপাতাল ও চমেক হাসপাতালে ৩০ থেকে ৪০ হাজার মানুষ নতুন করে রেজিস্ট্রেশন করেছেন। কিন্তু এসব কেন্দ্র একটা নির্দিষ্ট সংখ্যার বেশি টিকা দিতে পারে না। "
"যে কেন্দ্রগুলোতে নিবন্ধন কম, সেই কেন্দ্রগুলো থেকে আগেই এসএমএস পাচ্ছে। জট কমানোর জন্য এখন যেসব কেন্দ্রের চাপ বেশি, সেখান থেকে নিবন্ধনগুলো এসএমএস চাপ কম এমন কেন্দ্রে ট্রান্সফার করা যায় কি না, সে চিন্তা করা হচ্ছে।"