সর্বোচ্চ সড়ক দুর্ঘটনার ১৮৩ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১০৬তম: প্রতিবেদন
ওয়ার্ল্ড হেলথ র্যাঙ্কিং অনুসারে, সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনাকবলিত ১৮৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশেরঅবস্থান ১০৬তম। চলতি বছরের প্রথম আট মাসে দেশে ৩ হাজার ৭০১টি সড়ক দুর্ঘটনায় মোট ৩ হাজার ৫০২ জন নিহত এবং ৩ হাজার ৪৭৯ জন আহত হন। বাংলাদেশ পুলিশের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এ তথ্য।
৬১.৯০ শতাংশ মৃত্যু হার নিয়ে সবচেয়ে অনিরাপদ রাস্তার তালিকায় শীর্ষস্থানে রয়েছে জিম্বাবুয়ে।তারপর যথাক্রমে রয়েছে লাইবেরিয়া, মালাউই, গাম্বিয়া ও টোগো।
অন্যদিকে সবচেয়ে নিরাপদ সড়কের তালিকায় শীর্ষস্থানে রয়েছে সুইডেন। দেশটিতে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর ২.৩১ শতাংশ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনার কারণে প্রতিবছর বিশ্বে ১৩ লাখ মৃত্যু ঘটছে। এসব দুর্ঘটনায় বেশিরভাগ দেশের জিডিপির ৩ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তবে ৯৩ শতাংশ দুর্ঘটনাই ঘটছে স্বল্প ও মধ্য আয়ের দেশে, যেখানে রয়েছে বিশ্বের মোট সড়ক যানের ৬০ শতাংশ।
বৈশ্বিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ সড়কের জন্য কুখ্যাত দেশগুলো হলো- থাইল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, মালয়েশিয়া, ব্রাজিল, চীন, রাশিয়া, ভারত, কলম্বিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং পেরু। এই দেশগুলো দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যাতেও এগিয়ে।
'সড়ক নিরাপত্তার সম্ভাবনা নির্দেশক ও চ্যালেঞ্জসমূহ: স্বল্প ও মধ্য আয়ের দেশের প্রোফাইল' শীর্ষক এ প্রতিবেদনটি ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার সঙ্গে সড়ক ব্যবহারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। যেমন দরিদ্র মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহনে চলাচলে বাধ্য হন। একারণে তারা ভারতসহ স্বল্প ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে বেশি দুর্ঘটনার শিকারও হয়ে থাকে।
গেল বছর বাংলাদেশে ৪ হাজার ১৯৮টি দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৯১৮ জন প্রাণ হারিয়েছে। এর আগে ২০১৯ সালে ৪ হাজার ১৪৭টি দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ৪ হাজার ১৩৮ জন প্রাণ হারান। ২০১৮ সালে ২ হাজার ৬২৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন ২ হাজার ৬৩৫ জন। এছাড়া আহত হন আরও ১ হাজার ৯২০ জন।
তবে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মতো সড়ক নিরাপত্তা সংস্থাগুলোরদাবি অনুযায়ী দেশে সড়ক দুর্ঘটনার চিত্র আরও ভয়াবহ।
যাত্রী কল্যান সমিতির গেল বছরের বার্ষিক সড়ক দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশে মোট ৪ হাজার ৮৯১টি ট্রাফিক দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৬৮৬ জন মারা গেছেন।এছাড়া আহত হয়েছেন ৮ হাজার ছয়শ জন।
এই তথ্য অনুযায়ী, গত বছর দেশে গড়ে প্রতিদিন ট্রাফিক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১৮ জন।
আঞ্চলিক মহাসড়কে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ২০১৯ এরতুলনায় ২০২০ সালে ৬.৭৮ শতাংশ বাড়লেও অন্যান্য ক্ষেত্রে তা কমেছে। বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, জাতীয় মহাসড়কে ৩.৪৫, রেল ক্রসিংগুলোতে ০.১৬ এবং ফিডার সড়কগুলোতে ২.১৯ শতাংশ করে কমেছে দুর্ঘটনা।
এদিকে, বিশ্বব্যাংকের (ডব্লিউবি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের মোট যানবাহনের মাত্র ০.৫ শতাংশ বাংলাদেশে থাকা সত্ত্বেও ২০১৯ সালে দেশে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান।
এছাড়া, ২০১৬ সালের তথ্যের ভিত্তিতে, দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ২৪ হাজার ৯৫৪ জন মৃত্যুবরণ করেন। এতে বলা হয়, সড়ক দুর্ঘটনা ও সংশ্লিষ্ট দুর্ঘটনায় দেশে প্রতি লাখে প্রায় ১৫ জন মারা যায়। এদিকে, সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশ সরকার মাত্র ২ হাজার ৩৭৬ জন নিহত হওয়ার কথা জানালেও ডব্লিউএইচও এর অনুমান অনুযায়ী ২০১৬ সালে দেশে মারা গেছে ২৪ হাজার ৯৫৪ জন।
ডব্লিউবি-এর রিপোর্টে আরও বলা হয়, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতের ৬৭ শতাংশই ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী। এক্ষেত্রে মৃত্যুর ঝুঁকিতে রয়েছে মূলত ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী ব্যক্তিরা। এছাড়া, সড়ক দুর্ঘটনায় পুরুষ ও নারীর মৃত্যুর অনুপাত ৫:১।
বিশ্বব্যাংকের মতে, উচ্চ আয়ের দেশগুলোর তুলনায় নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার তিনগুণ বেশি। এসব কারণে দেশে সেবছর ১১ হাজার ৬৩০ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে বলে জানায় তারা। সে বছর সড়ক দুর্ঘটনাজনিত কারণে বাংলাদেশের জিডিপির ৫.৩ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলেও উল্লেখ করে তারা।
এদিকে বিশ্বের মাত্র ১ শতাংশ যানবাহন থাকার পরও বৈশ্বিকভাবে সড়ক দুর্ঘটনায় মোট মৃত্যুর ১১ শতাংশ ঘটছে প্রতিবেশী ভারতে। সংখ্যার বিবেচনায় যা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বলে জানানো হয় চলতি বছরে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে। বিশ্বব্যাংক গ্রুপের মতে, সড়ক দুর্ঘটনায় ভারতে প্রতিবছর দেড় লাখ মৃত্যু ঘটছে।
এতে প্রতিবছর ভারতের জিডিপির ৩.১৪ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন, যার আর্থিকমূল্য ৫ লাখ ৯৬ হাজার কোটি রুপি।
এর আগে চলতি বছরের জানুয়ারিতে 'নিরাপদ সড়ক চাই' আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ইলিয়াস কাঞ্চন ২০২০ সালে ৪ হাজার ৯৯৬ জনের মৃত্যু ও ৫ হাজার ৮৫ জনের আহত হওয়ার কথা জানান।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মতে, গত দুই দশকে সড়ক দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ৫৬ হাজার ৯৮৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।
অর্থাৎ, গত ২০ বছরে প্রতিদিন গড়ে ৮ জনের প্রাণহানি হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তুলনামূলক ছোট যানবাহনগুলো নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মহাসড়কে চলাচল করে। ফলে বড় যানবাহনের সঙ্গে প্রায়ই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে, যা সড়কে উচ্চ মৃত্যু হারের অন্যতম কারণ।
এছাড়া, সড়ক দুর্ঘটনার অন্য দুটি বড় কারণ, যানবাহনের অনিয়ন্ত্রিত চলাচল এবং চালকদের বেপরোয়া ড্রাইভিং।
অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই) জানিয়েছে, ৯০ শতাংশ দুর্ঘটনার জন্যই চালকরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দায়ী।
মহামারির কারণে ২০১৯ সালের চেয়ে ২০২০ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু ২১ শতাংশ কমেছে বলে জানায় এআরআই। মূলত করোনা সংক্রমণ রোধে দেশজুড়ে চলাচল ও পরিবহন নিষেধাজ্ঞার কারণেই এই হ্রাস।
তবে একারণে মোট সংখ্যা কমলেও দুর্ঘটনার হার কমেনি বলে জানান এআরআই এর একজন সহকারী অধ্যাপক। নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের হিসাবে, গেল বছর সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং ময়মনসিংহে। আর সবচেয়ে কম হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, খাগরাছড়ি ও বান্দরবন জেলায়।
সড়ক দুর্ঘটনায় অকাল মৃত্যু এদেশে নতুন কিছুই নয়। পরিবহন খাত একটি দেশের অর্থনীতির প্রাণভোমরা হলেও, আজো আমরা সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারিনি। রাজধানী ঢাকার যানবাহনে ভরা সড়কেও প্রতিনিয়ত ছোটবড় দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন আপামর জনতা। প্রতিটি পরিবারের স্বজন হারানোর যন্ত্রণা গণমাধ্যমে আলাদা করে তুলে ধরাও সম্ভব নয়।
সম্প্রতি এমনই এক দুর্ঘটনায় রাজধানীর গুলিস্তানে সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির চাপায় অকালে মৃত্যু হয়েছে নটরডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসানের।
বিচারক হতে চাওয়া ছেলেটির এই অকালমৃত্যু ছাত্র সমাজকে ক্ষুদ্ধ করেছে, নামিয়েছে আন্দোলনে। কিন্তু, অতীতের ছাত্র আন্দোলন থেকেও কী আমাদের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আরও সচেতন হয়েছেন? নিয়েছেন দুর্ঘটনা প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা? প্রশ্নগুলোর উত্তর কারোরই অজানা নয়। আমরা তেমন কোনো বাস্তবিক অগ্রগতি দেখিনি।
শুধু বাংলাদেশেই নয়- অপর্যাপ্ত সড়ক অবকাঠামো, বেপরোয়া গাড়ি চালক, সনদহীন যানবাহন, ট্রাফিক অব্যবস্থাপনা এমন অনেক কারণেই সড়ক দুর্ঘটনা আজ বিশ্বব্যাপী অকালমৃত্যুর বড় মাধ্যম। সমস্যাগুলো সমাধানে যেসব দেশে কর্তৃপক্ষ বেশি উদাসীন, সেখানে মৃত্যুর মিছিলও বাড়ছে।