সাবমেরিন ক্যাবলের বিদ্যুৎ পাল্টে দিয়েছে চরের অর্থনীতি
সাবমেরিন ক্যাবলে আসা বিদ্যুতে শরীয়তপুরের ৪টি চরে লেগেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। কৃষি, ব্যবসা বাণিজ্য আর কলকারখানা গতি পেয়েছে। ঘুরতে শুরু করেছে অর্থনৈতিক চাকা। শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা ও প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচয়েও বিদ্যুৎ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এখন। নতুন নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন চরবাসী।
শরীয়তপুরের মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন চারপাশে পদ্মা মেঘনা বেষ্টিত ছোট বড় অসংখ্য চর। এসব চরে যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম নৌপথ।
ভৌগলিকভাবে বিচ্ছিন্ন এসব চরে পৌঁছাতে শুরু করেছে বিদ্যুতের আলো। বিদ্যুৎ আসবে ভাবনায়ও ছিল না এখানকার বাসিন্দাদের। পদ্মার তলদেশ দিয়ে সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়েছে কাচিকাটা, চরাআত্রা, কুন্ডেরচর ও নওয়াপাড়া ইউনিয়নে। বিদ্যুৎ বিতরণে চরের মধ্যে নির্মাণ করা হয়েছে একটি সাব স্টেশন। বিদ্যুতের বহুবিধ সুবিধা পেয়ে দারুণ খুশি চরের মানুষেরা।
গ্রামের ভিতর ঢুকতেই দেখা গেল ঘরে ঘরে বিদ্যুতের সংযোগ লেগেছে। চরের দরিদ্র মানুষের ঘরগুলো নাজুক কিন্তু বিদ্যুতের সংযোগ থেকে বাদ যাচ্ছে না কেউই। দেওয়াকান্দি গ্রামের মাফিয়া বেগম রান্নার কাজ করছেন। থাকার ঘরটি বেশ ছোট। কাঁচামাটির ওপর নড়বড়ে টিনের ঘরটি। সেই ঘরেই দেয়া হয়েছে বিদ্যুতের সংযোগ। রান্না ঘরে বসেই কথা হয় মাফিয়া বেগমের সাথে। কথায় কথায় তিনি হিসাব দিতে থাকেন কিভাবে বিদ্যুৎ আসায় তার খরচ বাঁচল। বলেন, 'কিরিসেনত্যাল জ্বাললে একশো দ্যাশশো টাহা লাগদো আর অহনে যেমন পঞ্চাশ শাইট টাহাই অইয়া যায়। টাহা কম লাগে, আলো অইছে, উপকার পাইছি'।
৪টি চরে ছোট বড় মিলে রয়েছে ১০ টি হাট বাজার। বিদ্যুৎ পাওয়ায় বাজারগুলোও এখন বেশ জমজমাট। বেড়েছে ব্যবসা বাণিজ্যের পরিধিও। এসব বাজারে নতুনভাবে গড়ে উঠেছে ১৩টি কম্পিউটার - ফটোকপি দোকান, ৪টি টেলিভিশন - রেফ্রিজারেটর শো রুম, বিদ্যুতের যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম বিক্রির ৬ টি দোকান, ৩টি মোবাইল একসেসরিজ ও রিপেয়ারিং দোকান, ইলেক্ট্রিক মেশিনের সাহায্যে কাপড় সেলাইয়ের টেইলারর্স হয়েছে আরও ৫ টি।
এছাড়াও মাছ সংরক্ষণে গড়ে উঠেছে ৩ টি বরফকলও। মৎস সংরক্ষণে কয়েকটি বরফকল গড়ে উঠলেও সেগুলো চড়া মূল্য দিয়ে সোলার শক্তি ব্যবহার করতেন ব্যবহারকারিরা। এখন বিদ্যুৎ পেয়ে খুশি চরের এসব বরফকল মালিকরা। তারা বলছেন খরচ কমে এসেছে তিন ভাগে।
নওয়াপাড়া বাজারের ব্যবসায়ী মজিবর খা বলেন, 'বাজারে অন্তত দুইশ ব্যবসায়ী আছে। সবাই বিদ্যুৎ পেয়েছে। আগে সোলার জ্বালাত। সন্ধ্যা হলে মানুষ বেশিক্ষণ বাজারে থাকতো না। এখন অনেক রাত পর্যন্ত মানুষ বাজারে থাকে। বেচাকেনা বাড়ছে। লাভের মুখও দেখছি'।
তিনি আরও বলেন, 'আগে এই বাজারে ফ্রিজ ছিল না এখন অনেক ব্যবসায়ী ফ্রিজ কিনছে। ফটোকপি মেশিন, কম্পিউটারের দোকান হয়েছে। বিদ্যুৎ পেয়ে চরের ব্যবসায়ীরা লাভবান হয়েছে'।
জয়বাংলা বাজারের সাব্বির বরফ কলের মালিক শাহীন মোল্লা বলেন, 'সোলারের পাওয়ার হাউসের বিদ্যুতে ইউনিটে দিতাম ৩০ টাকা এখন পল্লী বিদ্যুতে লাগে ১২ টাকা। অর্ধেকেরও কম খরচ। প্রোডাকশনও বেশি করতে পারি। খরচ কমে গেছে আর ব্যবসা বাড়ছে'।
চরগুলো ঘিরে গড়ে উঠেছে আটটি জাহাজ নির্মাণের ডক ইয়ার্ড। এগুলোও ডিজেল চালিত জেনারেটর দিয়ে চলছিল। ডক ইয়ার্ডগুলো পেয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগ। নওয়াপাড়ার চরমন্ডল এলাকার সততা ডক ইয়ার্ডে গেলে দেখা যায় সেখানে বাল্কহেড নির্মাণ কাজ করছেন শ্রমিকরা। কথা হয় মালিক ছানাউল্লাহ ঢালীর সাথে। তিনি জানান, 'যেখানে ডিজেলে মাসে খরচ হতো ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। সেখানে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকার কারেন্ট খরচেই চলে যাচ্ছে। খরচ কমায় আমাদের লাভ বাড়ছে। এখন ব্যবসার চিন্তাই নতুন করে করতেছে অনেকে। আরও নতুন ডক হচ্ছে'।
বরাবরই শিক্ষায় পিছিয়ে চরাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর শিক্ষক সংকট তো রয়েছেই। তার ওপরে বিদ্যুতের অভাবে প্রযুক্তিগত জ্ঞান আহরণ ছিল দুঃস্বপ্ন। কেরোসিনের আলোয় বেশি রাত পর্যন্ত পড়াশুনাও ছিল চিন্তার বাইরে। সেই চরে আজ গভীর রাত পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের পড়াশুনায় মুখরিত। নতুনভাবে গড়ে ওঠা কম্পিউটার প্রশিক্ষণকেন্দ্রগুলোতে শিক্ষার্থীদের ভীড়।
নওপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেনীর শিক্ষার্থী ইয়াসমীন আক্তার। সাংবাদিক দেখেই এগিয়ে আসে। পড়াশুনার কথা বলতেই ঘরের ভেতরের টেবিল দেখিয়ে বলে এখানেই লেখাপড়া করি। তার টেবিলের ঠিক ওপরেই একটি বাল্ব। লেখাপড়ার কেমন চলছে জিজ্ঞেস করতেই বলে, 'করোনায় ইসকুল বন্ধ। বাড়িতেই পড়ি। তিন মাস ধরে কারেন্ট পাইছি। এখন তেলের চিন্তা করা লাগে না। মায় ঘুমাইয়্যা থাকে আমি বাতি জ্বালিয়ে পড়ি'।
নদী বেষ্টিত হওয়ায় চরে কৃষি ও মৎসে বেশ সম্ভাবনা রয়েছে। বর্ষায় পলি পড়ে উর্বর হয় এসব এলাকার জমি। তাই ফলনও হয় বাম্পার। প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হয় আলু, টমেটো, বেগুন, শসাসহ নান ধরনের সবজি এছাড়াও বিভিন্ন জাতের রবিশস্য। এখন বিদ্যুতে সুবিধা পেতে শুরু করেছে কৃষিখাত। এ বছর বোরো মৌসুমে ডিজেল চালিত ইঞ্জিনের ওপর পুরোপুরি নির্ভর করতে হবে না কৃষককে। সেচ কাজে ব্যবহার হবে বিদ্যুৎ শক্তিও।
কৃষক উজ্জল শিকদার বলেন, 'খরচ বেশি দেইখ্যা অনেক কৃষকই এই কাজ ছাইর্যা দিছে। তারা এখন কৃষি কাজ করবো। যেই জমিতে এক ফলস হইতো অহন সেখানে দুই তিন রকম ফসল চাষ করা যাবে। আর চলে একটা কোলেস্টরেল হলে আরও বেশি ফসল সেখানে রাখা যাবে। জমিতে পানি দিতে আর তেলের ওপর চাইয়্যা থাকতে হইবো না'।
মুন্সীগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালের ২২ এপ্রিল পদ্মার তলদেশ দিয়ে ১ কিলোমিটার পার হয়ে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যেমে চরগুলোতে বিদ্যুতায়নের কাজ শুরু হয়। নির্মাণ করা হয় ১০ এমভিএ ক্ষমতাসম্পন্ন উপকেন্দ্র। বিদ্যুতের খুঁটি ও সঞ্চালন লাইনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ২০২০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি নওয়াপাড় ও চরআত্রার বিদ্যুতায়নের উদ্ভোধন করেন পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ের উপমন্ত্রি এনামুল হক শামীম। এরই মধ্যে ৪হাজার ৪শ ৫৯ গ্রাহকের মাঝে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়েছে। ২০২১ সালের ২৬ মার্চের মধ্যে সব গ্রাহক বিদ্যুতের আওতায় আসবে।
মুন্সীগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মহাব্যবস্থাপক এএইচএম মোবারক উল্লাহ বলেন, 'ঢাকা অঞ্চলের মধ্যে সাবমেরিনে বিদ্যুৎ সংযোগ এটাই প্রথম। বিদ্যুৎ সংযোগের পর চর এলাকায় আর্থ সামাজিক ক্ষেত্রে এসেছে পবির্বতন। জাহাজ নির্মাণ শিল্প আলোর মুখ দেখেছে, বাজারগুলোতে ব্যবসার নতুন ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। দারুণ সম্ভাবনাময় চরের কৃষি ও মৎস শিল্প বিদ্যুতের ফলে আরও এগিয়ে যাচ্ছে। এ ধারা অব্যহত থাকলে বিদ্যুতের কারণে চর হয়ে উঠবে অথনৈতিক, বাণিজ্যিক আর শিল্প সমৃদ্ধ এলাকা। বিদ্যুৎ নিয়ে আমরা সে ভাবেই এগিয়ে যাচ্ছি'।
স্থানীয় সংসদ সদস্য ও পানি সম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম জানান, 'বিদ্যুৎ না থাকায় যুগ যুগ ধরে এই অঞ্চল অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে ছিল। নির্বাচিত হওয়ার পরই আমার প্রথম দিকের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে ছিল এসব চরে বিদ্যুতের আলো পৌঁছানো। কিন্তু বিড়ম্বনা ছিল চার দিকের পদ্মা মেঘনা নদী। কিন্তু আমরা দমে থাকিনি। পল্লী বিদ্যুতের সহযোগীতায় পানির তলদেশ দিয়ে ঢাকা অঞ্চলের মধ্যে প্রথম ৪টি চরে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়েছে। এখন এগিয়ে যাচ্ছে কৃষি, শিল্প, ব্যবসা বাণিজ্য। বদলে যাচ্ছে মানুষের জীবন ধারা'।
তিনি আরও জানান, চারদিকে পদ্মা মেঘনা আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর চরগুলো। এসব চর ঘিরে পর্যটন এলাকা গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। ইতোমধ্যে তা অনেক দূর এগিয়েছে।