সিলেটের শিশু পার্ক: নামকরণ জটিলতায় ১৫ বছর পার
সিলেটে শিশুদের জন্য নির্মিত একটি বিনোদন কেন্দ্র প্রকল্পটি শুরুর ১৫ বছর পরও উদ্বোধন হয়নি। শুধু নামকরণে বিভিন্ন মতের কারণেই এই দীর্ঘসূত্রিতা।
২০০৬ সালে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক) জেলার দক্ষিণ সুরমায় পার্কটি নির্মাণের উদ্যোগ নেয়।
সে সময় সিলেট-১ আসনের সাংসদ তখন এম. সাইফুর রহমান। অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রীর দায়িত্বেও তিনি ছিলেন। তার আগ্রহেই দক্ষিণ সুরমার আলমপুরে একটি শিশু পার্ক নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)।
তখন এই পার্কের নামকরণ করা হয় 'এম. সাইফুর রহমান শিশু পার্ক'। তবে পার্কের কাজ শেষ হওয়ার আগেই ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসে নতুন সরকার। পরে সাইফুর রহমানও মারা যান। তখন সিলেট করপোরেশনের মেয়র ছিলেন সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি প্রয়াত বদরউদ্দিন আহমদ কামরান।
অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সাইফুর রহমানের নামে থাকায় সিটি করপোরেশন এই পার্ক চালু করতে তখন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। ফলে আটকে যায় পার্কের কাজ।
এরপর ২০১৩ সালে বিএনপি দলীয় নেতা ও সাইফুর রহমানের ঘনিষ্টজন হিসেবে পরিচিত আরিফুল হক চৌধুরী মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর এই পার্ক চালুর ব্যাপারে আবার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
পার্কের সব কাজ শেষ হওয়ার পর তিনি সাইফুর রহমানের নামে পার্কটি চালুর ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা পাঠান। এই প্রস্তাবে রাজী হয়নি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।
এরপর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের পক্ষ থেকে পার্কটি শেখ হাসিনার নামে নামকরণের দাবি জানানো হয়।
তবে বিএনপি দলীয় মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী 'সিলেট ন্যাচারাল পার্ক', 'দক্ষিণ সুরমা পার্ক' নামে নামকরণের চেষ্টা চালিয়েও সফল হননি। এতে আটকে যায় পার্ক চালুর উদ্যোগ। সব কাজ শেষ হওয়ার পরও নামকরণ জটিলতায় দীর্ঘদিন ধরে আটকে আছে পার্কের উদ্বোধন। পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে রাখায় নষ্ট হচ্ছে বিদেশ থাকা আনা পার্কের রাইডগুলো। চুরি হয়ে গেছে পার্কে স্থাপন করা বৈদ্যুতিক সাব স্টেশনের যন্ত্রপাতি।
তবে সিসিক সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি 'জননেত্রী শেখ হাসিনা শিশু পার্ক' নামেই এই পার্কের নামকরণ করা হয়েছে। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে পার্কটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে সিসিক।
জানা যায়, ২০০৬ সালে নির্মাণ কাজ শুরুর পর মাটি ভরাট, সীমানা প্রাচীর নির্মাণ, বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন স্থাপন, দৃষ্টিনন্দন তোরণ নির্মাণসহ পার্কের অবকাঠামোগত কাজ শেষ হয়। এরপর সরকার পরিবর্তন হলে বন্ধ হয়ে যায় পার্কের কাজ।
আরিফুল হক চৌধুরী মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর, ২০১৭ সালে পার্কে বিভিন্ন রাইড বসানোর কাজ শুরু হয়। প্রায় ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে চীন থেকে এনে বিভিন্ন আধুনিক রাইড বসানো হয়, বিদ্যুৎ সংযোগ চালুসহ আনুসাঙ্গিক কাজও শেষ হয় তখন। তবে এরপর থেকেই দেখা দেয় নামকরণ জটিলতা।
তবে নামকরণ জটিলতা নিয়ে কেনো মন্তব্য করতে রাজী হননি সিসিকের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান। তিনি বলেন, নানা কারণে এই পার্ক যথাসময়ে চালু করা যায়নি। এখন পার্কের প্রায় সব কিছু তৈরি আছে। নামও চূড়ান্ত করা হয়েছে। যে কোনো সময় উদ্বোধনের তারিখ ঘোষণা করা হবে।
সিলেট সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, ২০০৬ সালে প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে দক্ষিণ সুরমার আলমপুরে ৩.৪৪ একর ভূমির উপর শিশু পার্ক নির্মাণের কাজ শুরু হয়।
মাটি ভরাট করে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ, পার্কের অবকাঠামোগত সব কাজ শেষ হয় ২০০৯ সালে। নামকরণ নিয়ে জটিলতার কারণে এরপর প্রায় ৮ বছর পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিলো পার্কটি। এই সময়ে জঙ্গল আর আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয় পুরো পার্ক।
পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকাকালীন পার্কের বৈদ্যুতিক সাবস্টেশনের মূল্যবান জিনিসপত্র চুরি হয়ে যায়।
এরপর আবার ২০১৭ সালে যখন পার্কে প্রায় ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৫টি রাইড বসানোর কাজ শুরু হয়। পার্কে বসানো রাইডগুলোর মধ্যে রয়েছে- রেলগাড়ি, স্লিপার, সসরাইড, বোট, হানি, সুইং, নাগরদোলা ইত্যাদি। তখন ৬ মাসের ভিতর পার্কটি চালু হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিল সিসিক। তবে রাইডগুলো বসানোর পর আরও ৪ বছর অতিক্রম হলেও শিশু পার্কটি চালু করতে পারেনি সিসিক। ফলে অনেক রাইডই এখন নষ্ট হয়ে গেছে।
'সিলেট ন্যাচারাল পার্ক' নামে পার্কটি চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েও ব্যর্থ হয় সিসিক। এরপরও জটিলতা না সারায় 'জননেত্রী শেখ হাসিনা শিশু পার্ক' নামকরণ করা হয় পার্কটির। সম্প্রতি এই পার্কের মূল ফটকে ' 'জননেত্রী শেখ হাসিনা শিশু পার্ক' সাইনবোর্ড টানানো হয়েছে।
সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল শাখার কর্মকর্তারা জানান, পার্কটি পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকাকালীন বৈদ্যুতিক সাবস্টেশনের সরঞ্জামাদি চুরি হয়ে যাওয়ার কারণে এতদিন বিকল্পভাবে বিদ্যুৎ সংযোগের মাধ্যমে কাজ চলছে। এখন সাবস্টেশনের সকল সরঞ্জামাদি আনা হয়েছে। এছাড়া দীর্ঘদিন পড়ে থাকায় রাইডের যে যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল সেগুলোও সংস্কার করা হয়েছে।
সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী আলী আকবর চৌধুরী বলেন, "পার্কের সকল কাজ সম্পন্ন হয়েছে। নাম সংক্রান্ত জটিলতাও আর নেই। 'জননেত্রী শেখ হাসিনা শিশু পার্ক' নামেই পার্কটি চালু হবে। বিদুৎ সাবস্টেশনের যে মালামাল চুরি হয়েছিল সেগুলোও আনা হয়েছে।"
করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলেই এটি উদ্বোধন করা হবে বলে জানান তিনি।