স্কুলছাত্র তিতাসের মৃত্যু: যুগ্ম সচিব ও ডিসির দায় পায়নি তদন্ত কমিটি
স্কুলছাত্র তিতাস ঘোষের মৃত্যুর ঘটনায় যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ আবদুস সবুর মণ্ডলকে দায়ী করার ‘যৌক্তিক কারণ’ নেই। ঘটনা তদন্তে গঠিত সরকারের উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি এমনটা জানায়।
ঘটনাটিতে মাদারীপুর জেলার ডিসিরও দায় ‘খুঁজে পায়নি’ তদন্ত কমিটি। বরং ঘটনাটির জন্য ফেরিঘাটের ব্যবস্থাপক, প্রান্তিক সহকারী ও উচ্চমান সহকারীর অবহেলা, অদক্ষতা ও অযোগ্যতাই দায়ী এটা বলা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে।
৩১ জুলাই হাইকোর্টের বিচারপতি এফআরএম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কেএম কামরুল কাদেরের বেঞ্চ ‘অতিরিক্ত সচিবের নিচে নয় এমন কর্মকর্তা’ দিয়ে ঘটনার তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দিতে জনপ্রশাসন সচিবকে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
সে প্রেক্ষিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ রেজাউল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের প্রশাসনিক তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। কমিটি বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে প্রতিবেদন জমা দেন।
তদন্ত দলের অপর দুই সদস্য হলেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আবদুস সাত্তার শেখ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিরাপত্তা বিভাগের যুগ্ম সচিব তোফায়েল ইসলাম।
অবকাশ শেষে প্রতিবেদনটি আদালতে উপস্থাপন করা হবে বলে জানিয়েছেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল (ডিএজি) আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার।
তদন্ত কমিটির অনুসন্ধান ও সুপারিশমালা
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে কাঁঠালবাড়ি ফেরিঘাটের ব্যবস্থাপক সালাম হোসেন, ঘাটের প্রান্তিক সহকারী খোকন মিয়া এবং উচ্চমান সহকারী ও গ্রুপ প্রধান ফিরোজ আলমকে দায়ী করা হয়।
বলা হয়েছে, নির্ধারিত সময়ের দু’ঘণ্টা দেরিতে ফেরি ছাড়ায় তিতাসের মৃত্যু হওয়ার দায় এ তিনজন এড়াতে পারবেন না।
তদন্ত কমিটি দেখেছে যে, ফেরিঘাটে একজন মুমূর্ষু রোগী অ্যাম্বুলেন্সে আছে সেটা যুগ্ম সচিব আবদুস সবুর মণ্ডল জানতেন না। তার অজ্ঞতাবশত কোনো দুর্ঘটনা ঘটে থাকলে তাকে দায়ী করার যুক্তিসঙ্গত কারণ পাওয়া যায়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
অন্যদিকে, মাদারীপুরের জেলা প্রশাসককেও জানানো হয়নি যে, ফেরিঘাটে একজন মুমূর্ষ রোগী অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে রয়েছে। ফলে তাকেও দোষারোপ করার যৌক্তিকতা পাওয়া যায়নি।
আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার জানান, প্রতিবেদনে সাত দফা সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। এগুলো হচ্ছে, ঘাটে ফেরি পৌঁছুনো ও ছাড়ার সময় রেজিস্টার বইয়ে লিখে রাখা, ভিআইপি যাতায়াত থাকলে তা আগেই জানিয়ে রাখা এবং এটি সরকারি সফর কি না সেটি নিশ্চিত করা।
প্রতিবেদনে অ্যাম্বুলেন্স বিষয়েও কিছু নির্দেশনা রয়েছে। ঘাটে অ্রাম্বুলেন্স থাকলে কোনোভাবেই ফেরি ছাড়তে দেরি না করা এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেটির পারাপারের সুযোগ করে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
ফেরিতে সিসিটিভি ক্যামেরা সংযুক্ত করতেও বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।
সে সঙ্গে, সংশ্লিষ্ট দায়িত্বরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নির্দিষ্ট পোশাক পরতে হবে এবং প্রত্যেক ফেরিতে গুরুত্বপূর্ণ মোবাইল নম্বর প্রদর্শন করতে হবে।
যেভাবে মৃত্যু হল তিতাসের
১১ বছরের তিতাস ঘোষ ছিল নড়াইলের কালিয়া উপজেলার পৌর এলাকার মৃত তাপস ঘোষের ছেলে। কালিয়া পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ত।
২৮ জুলাই বিকেলে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় তিতাস গুরুতর আহত হয়। প্রথমে তাকে খুলনার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য বৃহস্পতিবার রাতেই তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে পাঠানোর কথা বলেন চিকিৎসক। তাই চিকিৎসাসেবা অব্যাহত রেখে দ্রুত ঢাকায় পৌঁছাতে অর্ধলাখ টাকায় ভাড়া করা হয় আইসিইউ সংবলিত অ্যাম্বুলেন্স।
রাত আটটার দিকে অ্যাম্বুলেন্সটি মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি ১ নম্বর ভিআইপি ফেরিঘাটে এসে থামে। তখনও ওই ঘাটে ‘কুমিল্লা’ নামে একটি ফেরি ছিল। এ সময় মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক ঘাট কর্তৃপক্ষকে পাঠানো বার্তায় জানান, সরকারি একজন উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা ফেরিতে পদ্মা পাড়ি দেবেন। তাই ১ নম্বর ঘাটের ফেরিটি ছাড়া যাবে না।
নির্দেশ মেনে ঘাট কর্তৃপক্ষ ওই কর্মকর্তার গাড়ি না আসা পর্যন্ত ফেরি ছাড়েনি।
তিতাসের স্বজনদের অভিযোগ, তারা তো বটেই, আশপাশের লোকজনও ঘাট কর্তৃপক্ষকে ফেরি ছাড়তে বার বার অনুরোধ করছিলেন। তারা দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের কাছে সাহায্য চান। সেখানেও সাহায্য পাওয়া যায়নি।
এমনকি সরকারি জরুরি সেবা পেতে ৯৯৯ নম্বর ফোন করেও কাজ হয়নি।
তিন ঘণ্টা পর রাত পৌনে ১১ টার দিকে সাদা রঙের একটি নোয়া মাইক্রোবাস ফেরিতে ওঠার পর ছাড়া হয় ফেরি। কিন্তু আধ ঘণ্টার মধ্যেই মস্তিষ্কে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়ে মাঝনদীতে অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর মারা যায় তিতাস।
গণমাধ্যমে তোলপাড় এবং…
ঘটনার চার দিন পর বিষয়টি জানাজানি হলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে তিতাসের মৃত্যু নিয়ে সংবাদ প্রকাশ ও প্রচারিত হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও শুরু হয় ব্যাপক তোলপাড়।
জানা যায়, সরকারের এটুআই প্রকল্পের যুগ্ম সচিব আবদুস সবুর মণ্ডল সেদিন পিরোজপুর থেকে ঢাকায় যাচ্ছিলেন। তিনি কাঁঠালবাড়ি ঘাটে যাওয়ার আগে মাদারীপুরের জেলা প্রশাসকের কাছে ফেরিতে যাওয়ার বিষয়টি জানান। তখন জেলা প্রশাসক ঘাটের ব্যবস্থাপককে সে বিষয়ে বার্তা পাঠান।
এ ঘটনায় মানবাধিকার সংগঠন লিগ্যাল সাপোর্ট এন্ড পিপলস রাইটসের চেয়ারম্যান জহির উদ্দিন লিমন ৩০ জুলাই বাদী হয়ে জনস্বার্থে হাই কোর্টে একটি রিট করেন। রিটের ওপর শুনানি শেষে আদালত ৩১ জুলাই তদন্তের নির্দেশের পাশাপাশি রুল জারি করেন।
রুলে তিতাসের পরিবারকে তিন কোটি টাকা কেন ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না এবং তদন্তপূর্বক দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না তা জানতে চাওয়া হয়।