স্বাস্থ্যখাতের মূল্যায়ন ও দুর্বলতা দূর করতে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম
স্বাস্থ্যখাতের টেকসই উন্নয়নে সময়মত মানসম্পন্নভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন জোরদার করা ও কেনাকাটায় অনিয়ম রুখতে মাসব্যাপী ক্র্যাশ প্রোগ্রাম নিতে যাচ্ছে সরকার। এর অংশ হিসেবে প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের অধীনস্থ দপ্তরগুলোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং দেশের সকল সরকারি হাসপাতালগুলোর মান পর্যালোচনা করা হবে। আগামী জুলাই থেকেই এ কার্যক্রম শুরু হবে বলে জানিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
এছাড়া, দেশের সকল সরকারি হাসপাতালগুলোতে কোন ধরণের যন্ত্রপাতি রয়েছে এবং কোন ধরণের যন্ত্রপাতি দরকার, তার তালিকা করে সে অনুযায়ী তা কিনে সরবরাহ করা হবে। এর মাধ্যমে এ খাতের কেনাকাটায় অনিয়মে লাগাম পড়ানোর উদ্যোগও রয়েছে।
এ বিষয়ে অর্থবিভাগের সিনিয়র সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার জানান, স্বাস্থ্যখাতে প্রকল্প বাস্তবায়ন ও কেনাকাটার সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের ব্যবস্থাপনা ও দক্ষতায় সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে। এটি দূর করতে নতুন অর্থবছরের শুরুতেই ক্র্যাশ প্রোগ্রাম নেওয়া হবে। এতে স্বাস্থ্যখাত নিয়ে যে ধরণের অভিযোগ রয়েছে, তা দূর হবে।
'স্বাস্থ্যখাতে কেনাকাটা হয় সরবরাহকারীর চাহিদার ভিত্তিতে। এ ধারা পরিবর্তন করে চাহিদাভিত্তিক কেনাকাটা নিশ্চিত করা হবে। দেশের সকল হাসপাতাল মূল্যায়ন করে কোন ধরণের যন্ত্রপাতির কি পরিমাণ প্রয়োজন, তা চিহ্নিত করার পর সেগুলো কেনা হবে', যোগ করেন তিনি।
গত ৩ জুন জাতীয় সংসদ ভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিশেষ মন্ত্রিসভা বৈঠকে প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বাস্থ্যখাতের ব্যর্থতা, কেনাকাটায় অনিয়ম রোধ করা এবং মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে অর্থ মন্ত্রণালয় দ্রুত ক্র্যাশ প্রোগ্রাম বাস্তবায়নের প্রস্তাব করলে প্রধানমন্ত্রী তাতে সম্মতি দেন।
স্বাস্থ্যখাত মূল্যায়ন ও খাতটির দুর্বলতা দূর করায় উপায় বের করতে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব লোকমান হোসেন মিয়ার সঙ্গে কয়েকবার বৈঠক করেছেন অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদার। সেখানে স্বাস্থ্যখাতের প্রকল্প বাস্তবায়নে নিয়োজিত প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া চিকিৎসক, কেনাকাটার সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাসহ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও তার অধীনস্থ সকল সংস্থার সংশ্লিষ্টদের পাবলিক ফাইন্যান্স ম্যানেজমেন্ট, প্রকিউরমেন্ট ও ফরেন এইডেড প্রকল্পের তহবিল ব্যবহার নিয়ে মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নে প্রতিবছর বরাদ্দ বাড়ানো হলেও তা ব্যয় করতে পারছে না স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ। নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এ খাতের বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু ব্যবস্থাপনায় দূর্বলতা ও সক্ষমতার অভাবে তা ব্যয় করতে পারছে না। গতবছর করোনা সংক্রমণের পর স্বাস্থ্যখাতের দৈন্যদশা অনেক বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠে।
চলতি অর্থবছরের বাজেটের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে স্বাস্থ্যসেবা খাতে বরাদ্দ ছিল ১১,৯৭৯ কোটি টাকা, অর্থবছরের ১০ মাস শেষে তাদের বাস্তবায়নের হার মাত্র ২১ শতাংশ।
অথচ মহামারি সামলাতে যন্ত্রপাতির জন্য নিয়ম ভেঙ্গে বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে দু'টো প্রকল্প একসাথে অনুমোদন দিয়েছিল সরকার। শুরুতেই কেনাকাটায় বড় ধরণের অনিয়ম প্রকাশ হওয়ার পর হয় বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে নেওয়া প্রকল্পটি থমকে যায়, আর এডিবির প্রকল্পে কোন ব্যয়ই করতে পারেনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ভ্যাকসিনের জন্য বাজেটে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ থাকলেও সরকারিভাবে ভ্যাকসিন আমদানির জন্য এখনও সফল হয়নি স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ।
স্বাস্থ্যখাতের অনিয়ম ও ব্যর্থতা নিয়ে বিরোধী দল, সুশীল সমাজের পাশাপাশি সরকারের মন্ত্রীরাও সরব হয়েছেন। সম্প্রতি সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতার কথা স্বীকার করেছেন।
তিনি বলেছেন, যথাসময়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনও রাশিয়া ও চীন থেকে ভ্যাকসিন পেতে বিলম্বের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতাকে দায়ী করেছেন।
অর্থবিভাগের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, রাজধানীর সেগুনবাগিচায় পাবলিক ফাইন্যান্স ইনস্টিটিউটে জুলাই থেকেই প্রশিক্ষণ শুরু হবে। একই সঙ্গে চলবে স্বাস্থ্যখাতের মূল্যায়নের কাজও।
`শুধু প্রশিক্ষণ দিয়েই অর্থবিভাগ তার দায়িত্ব শেষ করবে না। দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যখাতের মানোন্নয়নে এ খাতের প্রকল্প বাস্তবায়ন ও কেনাকাটা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হবে। দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা অব্যবস্থাপনা দূর করতে প্রয়োজনীয় সহযোগিতার পাশাপাশি কেনাকাটায় স্বচ্ছতা আনতে হস্তক্ষেপও করা হবে', জানান তিনি।
ওই কর্মকর্তা জানান, স্বাস্থ্যখাতের প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। মূলত চিকিৎসকরাই এসব প্রকল্পের পরিচালক নিয়োগ পান। তাদের মধ্যে প্রশাসনিক দক্ষতার ঘাটতি প্রকট। আবার নিজেরা আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য প্রয়োজন না থাকলেও শুরুতেই কেনাকাটা করে থাকেন। দীর্ঘকাল ধরে খাতটি এভাবে চলে আসছে। মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে খাতটিকে ঢেলে সাজাতে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশনা রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, 'স্বাস্থ্যখাতের প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত চিকিৎসকদের দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণের উদ্যোগটি খুবই ভালো। আমরা দীর্ঘদিন ধরে এর সুপারিশ করে আসছিলাম। সরকার দেরিতে হলেও সে পথে হাঁটছে শুনে ভাল লাগছে'।
'একবার প্রশিক্ষণ দিয়ে থেমে গেলে চলবে না। প্রতিবছরই এ ধরণের প্রশিক্ষণ করাতে হবে। কারণ, প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িতরা প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হয়। তাছাড়া, সবার জন্য রিফ্রেশার ট্রেনিং থাকাও জরুরি', বলেন তিনি।
স্বাস্থ্যখাতকে মূল্যায়ন করার এ উদ্যোগ জরুরি ভিত্তিতে গ্রহণ করা উচিত বলেই অধ্যাপক হামিদ মনে করেন।