হলি আর্টিজান হামলার ৫ বছর: চাইলেও ভোলা যায় না যে ভয়াল রাত
সন্ধ্যা নামলেই জমে উঠতো গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি। গুলশান লেকের পাশে দৃষ্টিনন্দন এই বেকারিতে বিদেশি খাবারের স্বাদ নিতে ছুটে আসতেন অতিথিরা। খাবারের ফাঁকে জমে উঠতো রাতের আড্ডা। দল বেঁধে রাতের খাবার খেতে আসতেন বিদেশি নাগরিকরা।
এ দৃশ্য এখন স্মৃতি। বদলে গেছে হলি আর্টিজান বেকারির চেহারা। ২০১৯ সালে সেখানে তৈরি হয়েছে একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি। বাড়ির মালিক শাহাদত মেহেদী গত এক বছর ধরে সপরিবারে সেখানে থাকেন।
সোমবার সরেজমিনে গুলশান ২ নম্বরের ৭৯ নম্বর সড়কের ৫ নম্বর বাড়ির সামনে গিয়ে দেখা গেছে-অনেকটাই যেন নিষ্প্রাণ এলাকাটি। বাড়ির মূল দরজা সারাক্ষণ বন্ধ রাখা হয়; যেন কেউ হুট করে ঢুকে পড়তে না পারেন বাড়ির ভিতরে। কী এক অজানা ভয় তাড়িয়ে বেড়ায় তাদের!
বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী নুর আলম টিবিএসকে বলেন, জঙ্গি হামলার পর চার বছরের মতো পরিত্যক্ত ছিল জায়গাটি। ডুপ্লেক্স বাড়ি বানিয়ে গত এক বছর ধরে পরিবার নিয়ে এখানে থাকেন মালিক।
"২৪ ঘণ্টাই বন্ধ রাখা হয় বাড়ির গেইট। বহিরাগত কারও প্রবেশের অনুমতি নেই," বাড়ির ভিতরে গিয়ে কথা বলতে চাইলে এ কথা বলেন নুর আলম।
২০১৬ সালের ১ জুলাই বাংলাদেশের ইতিহাসে নৃশংসতম জঙ্গি হামলা হয় এই বাড়ির হলি আর্টিজান বেকারিতে। হামলায় ২২ জনের প্রাণহানি ঘটে। এর মধ্যে ৯ জন ইতালীয়, ৭ জন জাপানি, ৩ জন বাংলাদেশি ও একজন ভারতীয় নাগরিক ছিলেন। পরের দিন কমোন্ডা অভিযানে ৫ জঙ্গি নিহত হয়।
জঙ্গি হামলার ছয় মাস পর হলি আর্টিজান বেকারিও স্থান পাল্টায়। গুলশান এভিনিউয়ের র্যাংগস আর্কেডের দ্বিতীয় তলায় স্বল্প পরিসরে বেকারিটি খোলা হয়েছে। সেখানে এখনও বেকারির ৫ জন সাবেক কর্মী কাজ করছেন যারা সেই ভয়াল রাতের সাক্ষী।
তাদেরই একজন সায়েদুর রহমান। সেই ভয়াবহ জঙ্গি হামলার কথা আজও ভুলতে পারেননি তিনি।
'এখনও কোন শব্দ শুনলে আঁতকে উঠি'
'ভাই, এখন অনেক ভাল আছি। তবে চাইলেও সেই ভয়াল রাতের কথা ভুলতে পারি না। এখনও কোন শব্দ শুনলে আঁতকে উঠি। চোখের সামনে গুলি করে এতগুলো মানুষকে নির্দয়ভাবে হত্যা করেছে জঙ্গিরা। সেই রাতের কথা কোনভাবেই বর্ণনা করে বুঝাতে পারবো না'-জঙ্গি হামলার রাতে ক্যাশ কাউন্টারে দায়িত্বপালন করছিলেন সায়েদুর রহমান। ভাগ্যক্রমে জীবন নিয়ে ফেরা সায়েদুর এভাবেই সেইদিনের স্মৃতিচারণ করেন।
সায়েদুর রহমান বলেন, 'ঘটনার দিন ক্যাশে বসে কাজ করছিলাম। সন্ধ্যার দিকে পাঁচ যুবক বেকারির গেটে আসেন। ভিতরে প্রবেশ করতে চাইলে নিরাপত্তাকর্মীরা তাদের বাঁধা দেন। ব্যাগের ভিতর থেকে অস্ত্র বের করে গুলি করতে শুরু করেন তারা'।
'বেকারির ভিতরে ঢুকে বিদেশি নাগরিকদের লক্ষ করে গুলি করতে শুরু করেন তারা। আমরা কয়েকজন দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে ছাদে চলে যাই। ছাদ থেকে পাশের ভবনে লাফিয়ে জীবন নিয়ে বেঁচে ফিরি'।
সায়েদুরের মতোই সেদিনের জঙ্গি হামলার প্রত্যক্ষদর্শী হলি আর্টিজান বেকারির আরেক স্টাফ মো. আকাশ।
মো. আকাশ বলেন, 'কাজের ফাঁকে সময় পেলে হলি আর্টিজানে ঘুরতে যেতাম । কিন্তু গত এক বছর ধরে আর পারি না। গেলে মন খারাপ হয়ে যায়। জঙ্গি হামলায় নিহত দুই সহকর্মী নারায়ণগঞ্জের শাওন আর মাদারীপুরের সাইফুলের কথা মনে পড়ে'।
তিনি বলেন, 'শাওনের মা বেঁচে আছেন। আমাদের মালিক এখনও ওর মায়ের জন্য প্রতিমাসে খরচ পাঠান'।
'আজ রাতে আর ঘুমোতে পারবো না'
হলি আর্টিজান বেকারির শেফ দেলোয়ার হোসেন বলেন, 'আপনার সঙ্গে কথা বলে আবারও সেই রাতের কথা মনে পড়ে গেল। আজ রাতে আর ঘুমোতে পারবো না ভাই'।
তিনি বলেন, 'আমি কিচেনে কাজ করছিলাম। জঙ্গিদের গুলির শব্দ শুনে আমরা আটজন পাশের একটি টয়লেটে পালাই। দফায় দফায় গুলি আর বোমার আওয়াজে মনে হচ্ছিল এই বুঝে মারা পড়বো'।
'রাত ২টার দিকে কেউ একজন টয়লেটের দরজায় নক দিলেন। আমরা সবাই ভয়ে কাঁপছিলাম। তারা হুমকি দিয়ে বলেন, দরজা খোল। না খুললে বোমা মেরে উড়িয়ে দিবে। আমি সামনে ছিলাম। দরজা খুলে দিলাম। দরজা খুলে দেখি অস্ত্র হাতে দুই যুবক। তারা বললো, হাত উঁচু করে দাঁড়া। আমরা সবাই তখন হাত উঁচু করে দাঁড়ালাম', যোগ করেন দেলোয়ার।
দেলোয়ার আরও বলেন, 'তারা আমাদের বললেন, 'তোমরা কারা'। আমরা বললাম, 'স্টাফ'। 'তোমরা কি মুসলমান? আমরা বললাম, 'হ্যা'। তখন তারা বাইরে থেকে দরজা আটকে দিয়ে চলে গেল। এর কিছুক্ষণ পর টয়লেটের ভিতর তীব্র অক্সিজেনের সংকট দেখা দিল। মনে হচ্ছিল, আমরা এমনিই মারা যাব। এরপর আমরা ভিতরে থাকা একটি রড দিয়ে সবাই মিলে পিছনের দেয়াল ভাঙ্গার চেষ্টা করি'।
'আওয়াজ শুনে আমাদের একজন সহকর্মীকে পাঠিয়ে আমাদের বের করে নেয়। বাইরে বের হয়ে দেখি শুধু রক্ত আর রক্ত। লাশগুলো মেঝতে পড়ে আছে । সেখানে দাঁড়িয়ে জঙ্গিরা আমাদের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বললেন। এভাবে আতংকের মধ্যে ভোর হল। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে জঙ্গিরা মারা গেল। আমাদের আটক করা হল। পরে নিয়ে যাওয়া হল ডিবি কার্যালয়ে । তিন ঘন্টা সেখানে থাকার পর মালিক গিয়ে আমাদের ছাড়িয়ে আনলেন'।
শুহিন নামের আরেকজন স্টাফ বলেন, 'আমরা যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলাম দোয়া করি কেউ যেন এমন পরিস্থিতির মধ্যে না পড়েন। পৃথিবীর কোথাও যেন এমন জঙ্গি হামলা না হয়। সেই রাতের স্মৃতি এখনও অনেক রাত আমাকে ঘুমাতে দেয় না'।
ভাল চলছে হলি আর্টিজানের নতুন শাখা
জঙ্গি হামলার পর ছয় মাস বন্ধ ছিল হলি আর্টিজান বেকারি। পরে গুলশান এভিনিউয়ের র্যাংগস আর্কেডের দ্বিতীয় তলায় স্বল্প পরিসরে বেকারিটি খোলা হয়েছে।
আগের পাঁচজন স্টাফ কাজ করছেন এই নতুন শাখায়। কেমন চলছে নতুন শাখা, জানতে চাইলে সায়েদুর রহমান বলেন, 'শুরুতে কিছুদিন কম চলেছে। তবে এখন আগের চেয়েও ভাল চলছে। আগে বিদেশি গ্রাহক বেশি ছিল। এখন বিদেশিদের পাশাপাশি প্রচুর দেশি গ্রাহক পাচ্ছি। বেকারির মালিকও আমাদের আগলে রেখেছেন'।