হাইকোর্টের পুনঃতফসিলিকরণ সুযোগ নিচ্ছে ঋণখেলাপিরা
বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর (সিআইবি) শীর্ষ খেলাপিদের তালিকায় নাম রয়েছে চট্টগ্রামের ডবলমুড়িং এলাকার মাহমুদ ফ্যাব্রিকস এন্ড ফিনিশিং লিমিটেডের। ৬টি ব্যাংকের ৩৮৮ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের বোঝা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির মাথায়।
বিভিন্ন সময় ব্যাংকগুলোর ঘোষিত 'বিশেষ সুবিধা'র ক্যাটাগরিতে প্রতিষ্ঠানটি সংশ্লিষ্ট সবগুলো ব্যাংকের কাছ থেকে তিন বার করে ঋণ পুনঃতফসিল সুবিধা ভোগ করে। ২০১৩ সালের পর আর এই সুবিধা ভোগ করতে পারেননি। ঋণ পুনঃতফসিলের আবেদন করলেও ব্যাংকগুলো তা পাত্তা দেয়নি।
ব্যবসার অবস্থা ভালো নয়, এই যুক্তি দেখিয়ে ২০১৪ সালের জানুযারি মাসে ঋণ পুনঃতফসিলকরণের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করে প্রতিষ্ঠানটি। সেইবার ছয় মাসের জন্য তার ঋণ পুনঃতফসিলকরণের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। ছয় মাস শেষ হলে আবার তা ছয় মাসের জন্য বাড়ানোর নির্দেশনা চেয়ে আবেদন করে।
এভাবে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ঋণ পুনঃতফসিলকরণের নির্দেশ বৃদ্ধি চেয়ে ৬ বার হাইকোর্টে আবেদন করে এবং আদালত তা মঞ্জুর করে। ৬ষ্ঠ বার হাইকোর্টের দেওয়া আদেশ চ্যালেঞ্জ করে ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে ব্যাংকগুলো আপিল করলে, হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করেন আপিল বিভাগ।
মাহমুদ ফ্যাব্রিকস এন্ড ফিনিশিং লিমিটেডের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মাসুদ মিয়া দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, আপিল বিভাগের আদেশের ফলে পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠানটি ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ পায়নি। সিআইবির তালিকায় নাম ওঠেছে। তবে প্রতিষ্ঠানটি ২০১৯ সালে সিআইবির তালিকা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করলে একটি বেঞ্চ তা শুনানিতে অপারগতা প্রকাশ করে। অন্য একটি বেঞ্চে শুনানির চেষ্টা করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত শুনানি হয়নি।
কোম্পানী আইন বিশেষজ্ঞ আইনজীবী প্রবীর নিয়োগী টিবিএসকে বলেন, আইন অনুযায়ী তিনবার ঋণ পুনঃতফসিল করার পর ঋণগ্রহীতারা ব্যাংকগুলোতে আর পুনঃতফসিলের সুযোগ পায় না। তারা একটা সহজ উপায় বের করে নিয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদনের মাধ্যমে বারবার এই সুযোগ নিচ্ছে।
হাইকোর্টের নির্দেশনা নিয়ে যত পুনঃতফসিলের সুযোগ
মাহমুদ ফ্যাব্রিকস এন্ড ফিনিশিং লিমিটেড নয়, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ২১,৪৮০ প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি হাইকোর্টের নির্দেশনা নিয়ে পুনঃতফসিলের সুযোগ পেয়েছে।
এর মধ্যে ২০১৫ সালে ৬৩২১, ২০১৬ সালে ৪১৬৮, ২০১৭ সালে ৩৪৪৬, ২০১৮ সালে ৩৬৩৮ এবং ২০১৯ সালে ৩৯০৭টি ঋণ পুনঃতফসিলের নির্দেশনা নিয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি।
সুপ্রিম কোর্ট সূত্র বলেছে, এসব আবেদনকারীদের ঋণের পরিমাণ কত, তার সঠিক হিসেব নেই তাদের কাছে। তবে ২০১৯ সালে ৩৯০৭ আবেদনকারীর ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা। এই ঋণ তারা পুনঃতফসিলের সুযোগ পেয়েছে। এছাড়াও ২০১৮ সালে ১২ হাজার কোটি টাকার ঋণ ছিল আবেদনকারীদের।
২০৬ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের বোঝা নিয়ে সিআইবির শীর্ষ তালিকায় থাকা রংপুরের অ্যাপল সিরামিকস প্রাইভেট লিমিটেড ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১১ বার হাইকোর্টের নির্দেশনা নিয়ে পূবালী, জনতা, এবি ও সিটি ব্যাংকের ঋণ পুন:তফসিল করে। পরবর্তীতে ব্যাংকগুলো হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করলে আর সম্ভব হয়নি।
কবে নিষ্পত্তি হবে ঋণ পুন:তফসিল সংক্রান্ত রুলগুলো
২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণ পুনঃতফসিলের নির্দেশনা চেয়ে ২১৪৮০টি রিট মামলা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, রিট করার পর আদালত শুনানি নিয়ে ঋণ পুনঃতফসিলের নির্দেশনা দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন ইস্যুতে রুল জারি করেছেন। সুপ্রিম কোর্ট সূত্র জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত প্রায় ৯৬০০টি রুল চূড়ান্ত শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
কখন আসে হাইকোর্টে
ব্যাংক ও কোম্পানী আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার শাহ মোহাম্মদ আহসানুর রহমান টিবিএসকে বলেন, কোনো ঋণের কিস্তি পরপর তিন মাস পরিশোধ না করলে ওই ঋণকে ব্যাংকিং ভাষায় সাব-স্ট্যান্ডার্ড বা নিম্নমানের ঋণ বলা হয়। অনুরূপভাবে কোনো ঋণ পরপর ছয় মাস পরিশোধ না করলে ডাউটফুল বা সন্দেহজনক ঋণ, আর ওই ঋণ পরপর ৯ মাস অতিক্রান্ত হলে তা ব্যাড অ্যান্ড লস বা কু-ঋণ বলা হয়। এ তিন শ্রেণীর ঋণই খেলাপি হিসেবে বিবেচিত। কোনো গ্রাহক খেলাপি হওয়ার পর ব্যাংক অথবা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিতে পারেন না। এমন কি কোনো জাতীয় নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করতে পারেন না।
তিনি বলেন, গ্রাহককে সুবিধা দিতে তাই খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। তবে কোনো গ্রাহককে বারবার এ সুযোগ দেয়ার বিধান নেই। সর্বোচ্চ তিনবার এ সুবিধা পেতে পারেন একজন গ্রাহক। তবে প্রথমবার তাকে মোট খেলাপি ঋণের ১৫ শতাংশ এককালীন নগদে পরিশোধ করে এ সুবিধা নিতে হয়। এরপরের দুইবার আরো বেশি এককালীন পরিশোধ করতে হয়।
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, তিনবারের পর যখন কোনো উপায় না থাকে খেলাপির তালিকায় নাম ঠেকাতে বা ব্যাংক থেকে আরও ঋণ নিতে, তখন হাইকোর্টে এসে আবেদন করে। তারা প্রভাবশালী আইনজীবী দিয়ে আদালতে মুভ করেন। বেশীরভাগ সময় আদালত তাদের পক্ষে আদেশ বা নির্দেশনা দেন।
খেলাপির তালিকায় নাম ঠেকানোর আরেক কৌশল
সোনালী ব্যাংকের প্রায় ৩০ কোটি টাকা ঋণ থাকা জাতীয় পার্টির নেতা ও জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ পটুয়াখালী-২ আসনের এমপি আ স ম ফিরোজ ২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগ পর্যন্ত হাইকোর্টের নির্দেশনা নিয়ে ৯ বার ঋণ পুনঃতফসিল করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, নির্বাচনের আগে এই ঋণ পুনঃতফসিল না করতে পারলে খেলাপির তালিকায় নাম উঠতো আ স ম ফিরোজের। সিআইবির তালিকায় নাম উঠলে তিনি নির্বাচনে অযোগ্য হতেন। কৌশল করে হাইকোর্টের আশ্রয় নিয়ে ঋণ পুনঃতফসিল করেন।
একই কৌশল অবলম্বন করেছেন মহেশখালী-কুতুবদিয়া আসনের এমপি আশেক উল্লাহ রফিক। জনতা ব্যাংকের প্রায় ২৯ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল করেছেন ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন মনোনয়ন জমা দেওয়ার আগে।
তার আইনজীবী জানিয়েছেন, এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি ওই টাকা পরিশোধ করেছেন।
একইপথে হেঁটেছেন বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার সৈয়দপুর ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান মাহমুদুল হাসান তৌফিক। ব্যবসা করার জন্য ঢাকা ব্যাংকের বগুড়া শাখা থেকে ৩৫ লাখ টাকার ঋণ তিনবার পুনঃতফসিল করার পর আটকে যান। ২০১৭ সালে ওই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের আগে হাইকোর্টে রিট করে ঋণ পুনঃতফসিল করার নির্দেশ নেন। ফলে নির্বাচনে অংশ নিতে তার কোনো সমস্যা হয়নি।
কোম্পানী আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার তানজীব-উল আলম টিবিএসকে বলেন, ঋণ পুনঃতফসিল করার জন্য একশ্রেণির গ্রাহক মরিয়া। আবার ব্যাংকগুলোরও অনেকাংশে গাফিলতি লক্ষ্য করা যায়।
তিনি বলেন, হাইকোর্টের এসব আদেশের বিরুদ্ধে খুব একটা আপিল হয় না। ব্যাংকগুলোর উচিত এরকম ক্ষেত্রে যথাযথ আইনি লড়াই করা।
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর টিবিএসকে বলেন, ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দেয়ার কারণেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমেছে। এছাড়া অন্য কোনো কারণ নয়। এখানে সুপ্রিম কোর্টের থেকে নেওয়া আদেশও বড় ভূমিকা রাখছে।
তিনি বলেন, ব্যালান্সশিট পরিচ্ছন্ন দেখাতে ব্যাংকগুলো বাছবিচার ছাড়াই খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করে থাকে। আইন অনুযায়ী কোনো ঋণ তিনবারের বেশি পুনঃতফসিলের সুযোগ না থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে তা মানা হচ্ছে না। আবার প্রভাবশালী গ্রাহকরা হাইকোর্টের আদেশ নিয়ে ১০ বারেরও বেশি পুনঃতফসিল সুবিধা নিচ্ছেন। ফলে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের চেয়ে পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠিত ঋণের হার বেড়ে গেছে।
তিনি বলেন, আদালতের উচিত এ রকম বিষয়ে শুনানির সময় বা আদেশের আগে যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই ও বিবেচনা করা।
ব্যারিস্টার শাহ মোহাম্মদ আহসানুর রহমান বলেন, ২০১৯ সালের জুলাই মাসে এক রায়ে ঋণ পুনঃতফসিল করার ক্ষেত্রে কঠোরতা অবলম্বনে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেন। ওই রায় অনুযায়ী কোন ব্যবসায়ী এই সুবিধা নিলে দুই মাসের মধ্যে আর অন্য কোন ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করতে পারবেন না। কিন্তু এই নির্দেশনার বাস্তবায়ন আছে বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, রাজনৈতিক ও নানা প্রভাবে ব্যাংকগুলো আইন না মেনে বারবার ঋণ পুনঃতফসিল করার নজির অন্যতম। আবার উচ্চ আদালতের আদেশ নিয়ে পুনঃতফসিল করার হচ্ছে। এইসব বিষয়ে রিট, মামলা ও আবেদন বিষয়ে কি সিদ্ধান্ত হবে, সে বিষয়ে প্রধান বিচারপতির সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকা উচিত তার অধীনস্ত আদালতগুলোর প্রতি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, ঋণ পুনঃতফসিলের বিষয়ে সময় সময় বাংলাদেশ ব্যাংক আদেশ জারি করে। সেই আদেশ যাতে ব্যাংকগুলো যথাযথ পালন করে সেজন্য মনিটরিং করা হয়। কিন্তু উচ্চ আদালত থেকে পুনঃতফসিল করার আদেশ আসলে ব্যাংকগুলোর কিছু করার থাকে না।
তবে, ব্যাংকের বিরুদ্ধে ও পক্ষে দায়ের করা বিভিন্ন মামলা নিষ্পত্তির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যথাযথ নির্দেশনা পালন করার কথা বলা হয়েছে।
এবি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন সেন্টারের (বিয়াক) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ এ. (রুমী) আলী বলেন, আইন ও আদালতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে ব্যাংকগুলো হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের আদেশ, রায় ও নির্দেশনাগুলো মেনে চলে।
আইনমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি এ রকম বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে ভেবেচিন্তেই কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন বলে আশা করেন মোহাম্মদ এ. (রুমী) আলী।
অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, সিআইবির তালিকায় নাম ঠেকানোর আবেদন ও ঋণ পুনঃতফসিলের আবেদনসহ ব্যাংক সংক্রান্ত যে কোনো মামলার ক্ষেত্রে আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বেশ সচেতন। এখন আগের মতো অহরহ আদেশ হয় না আবেদনকারীদের পক্ষে। পুনঃতফসিল সংক্রান্ত রিটের জারি করা অনিষ্পন্ন রুল শুনানির জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হবে আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হলেই।