১৫০ উপজেলার ১৩ লাখ বয়স্ক ও বিধবা নারী সরকারি ভাতা পাবেন
- বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক ভাতা ১২০০০ টাকা থেকে বেড়ে ২০,০০০ টাকা হচ্ছে
- ২০২১-২২ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে বরাদ্দ থাকছে প্রায় ১,০২,০০০ কোটি টাকা
দেশের দারিদ্র্যপ্রবণ ১৫০ উপজেলার সকল বয়স্ক, বিধবা ও নিঃস্ব নারীকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আনা হচ্ছে। এতে প্রায় ১৩ লাখ বয়স্ক ও বিধবা নারী নতুন করে আগামী জুলাই থেকে প্রতিমাসে সরকার থেকে নগদ ৫০০ টাকা করে ভাতা পাবেন। এতে প্রায় ৮০০ কোটি বাড়তি ব্যয় হবে।
এছাড়া, ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক ভাতা ১২,০০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০,০০০ টাকা করা হচ্ছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক অনুষ্ঠানে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বাড়ানোর ঘোষণার পর তা আগামী অর্থবছর থেকে কার্যকর করতে বাড়তি বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। এতে বছরে প্রায় দেড়শ কোটি টাকা বাড়তি ব্যয় হবে।
অর্থমন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, কোভিড মহামারীতে দারিদ্রের হার বৃদ্ধিসহ কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বাড়লেও আগামী বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ সে তুলনায় বাড়ছে না। এ খাতে বরাদ্দের পরিমাণ প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে ১,০২,০০০ কোটি টাকা নির্ধারণ করে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট প্রনয়ণ করছেন অর্থবিভাগের কর্মকর্তারা।
এর বাইরে চলতি অর্থবছরের বাজেটে চলমান সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর বিভিন্ন কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। সেখানে কোথাও কোথাও উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়িয়ে অধিকসংখ্যক মানুষকে সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা থাকবে। তবে আগামী অর্থবছরে উপকারভোগীদের ভাতার পরিমাণ বাড়ছে না।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতার উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ইতিবাচক। মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক ভাতা বাড়ানোটাও যৌক্তিক। তবে প্রচলিত এসব কর্মসূচি আগে থেকেই চলমান রয়েছে'।
তিনি বলেন, 'কোভিড পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে আগামী বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তায় জোর দিতে হবে। কারণ, এই সময়ে নতুন করে অনেকে কর্মহীন হয়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। তাদের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় আনা না গেলে দারিদ্র্যসীমার উপরে টেনে তোলা সম্ভব হবে না'।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ রয়েছে ৯৫,৫৭৪ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছর এটি বেড়ে ১,০২০০০ কোটি টাকা হতে পারে। সাধারণত প্রতিবছর বিভিন্ন খাতে উপকারভোগীর সংখ্যা ১০ শতাংশ হারে বাড়ানো হয়। খুব শিগগিরই অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠেয় এক সভায় উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।
বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত অর্থবিভাগের একজন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, 'করোনায় কর্মহীন ও নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নামা পরিবারগুলোকে সহায়তা করার জন্য বাজেটে পৃথক কোন কর্মসূচি থাকছে না। সেকেন্ড ওয়েভ মোকাবেলায় চলমান লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ঈদ উপহার দেওয়ার পাশাপাশি খাদ্য ও ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে'।
'কোভিড সংক্রান্ত যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলায় আগামী অর্থবছরের বাজেটেও ১০,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। মহামারীতে সামাজিক সুরক্ষায় কোথাও তাৎক্ষণিক সহায়তা দেওয়ার প্রয়োজন হলে এ তহবিল থেকে ব্যয় করা হবে', যোগ করেন তিনি।
এ কর্মকর্তা বলেন, 'বর্তমানে ৩০টি মন্ত্রণালয়ের অধীন ১২৩টি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চলমান রয়েছে। বিচ্ছিন্নভাবে এসব কর্মসূচি বাস্তবায়ন না করে এগুলোকে একই ছাতার (আমব্রেলা) আওতায় আনা প্রয়োজন। এজন্য যে সংস্কার দরকার, আগামী বাজেটেও তা অনুপস্থিত থাকছে'।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছর দারিদ্র্যপ্রবণ ১১২টি উপজেলার সকল বিধবা, বঞ্চিত ও নিঃস্ব নারীন ভাতার আওতায় আনা হয়েছে। সব মিলিয়ে দেশের ২০,৫০০০ নারী মাসে ৫০০ টাকা হারে এ ভাতা পাচ্ছেন। আগামী বছর নতুন করে ১৫০ উপজেলার এ ধরণের সকল নারীকে অন্তর্ভুক্ত করা হলে উপকারভোগীর সংখ্যা প্রায় ৫ লাখের মতো বাড়তে পারে।
এছাড়া, ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বের পুরুষ ও ৬২ বছরের বেশি বয়সের নারীদের বয়স্ক ভাতা দিচ্ছে সরকার। এ কর্মসূচির আওতায়ও দেশের ১১২ উপজেলার সকল বয়স্কদের মাসে ৫০০ টাকা করে ভাতা দেওয়া হচ্ছে। আগামী অর্থবছরে নতুন করে ১৫০ উপজেলার সকল বয়স্ককে এ কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এতে প্রায় ৮ লাখ উপকারভোগী যুক্ত হতে পারে। চলতি অর্থবছরে প্রায় ৪৯ লাখ বয়স্ক নাগরিক এ সুবিধা পাচ্ছেন।
জানা গেছে, রবিবার অনুষ্ঠিত বাজেট মনিটরিং ও সম্পদ কমিটির সভায় আগামী বাজেটের একটি রূপরেখা উপস্থাপন করেছেন অর্থসচিব আবদুর রউফ তালুকদার। সেখানে আগামী অর্থবছর সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণের পরিকল্পনার কথা জানান তিনি।
গত বুধবার অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সাংবাদিকদের বলেন, আগামী বাজেট দরিদ্রদের জন্য নিবেদিত থাকবে। গরীব মানুষদের প্রাধান্য দিয়ে বাজেট প্রণয়ন করা হবে। বাজেটে দরিদ্রদের জীবন-জীবিকাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে।
'গরীব মানুষদের দারিদ্র্য থেকে বের করে আনাই সরকারের উদ্দেশ্য। আমরা এমন সব পদক্ষেপ নিচ্ছি, যাতে দরিদ্ররা দারিদ্র্যসীমার উপরে উঠে আসবে, আর অতি দরিদ্ররা দরিদ্র হবে', যোগ করেন তিনি।
দুই বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পিপিআরসি ও বিআইজিডি গত সপ্তাহে এক জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে জানায় যে, করোনাকালে দেশের ২.৪৫ কোটি মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে এবং শহর ও গ্রামের মানুষের ঋণের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
বীর মুক্তিযোদ্ধার ভাতা সমান হচ্ছে
আগামী অর্থবছর থেকে খেতাবপ্রাপ্ত ও খেতাববিহীন বীর মুক্তিযোদ্ধারা সমান হারে মাসিক ভাতা পাবেন। গত ফেব্রুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের এক বৈঠকে সব মুক্তিযোদ্ধাকে সমান ২০ হাজার টাকা করে ভাতা দেওয়ার নির্দেশনা দেন।
বর্তমানে সাধারণ বীর মুক্তিযোদ্ধারা মাসে ১২ হাজার, শহীদ পরিবার ৩০ হাজার, মৃত যুদ্ধাহত পরিবার ২৫ হাজার, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ পরিবার ৩৫ হাজার, বীরোত্তম খেতাবধারীরা ২৫ হাজার, বীরবিক্রম খেতাবধারী ২০ হাজার ও বীর প্রতীকরা ১৫ হাজার টাকা করে পান।
বর্তমানে সারাদেশে ভাতাপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১,৮৬,৪০৮ জন। চলতি অর্থবছর মৃত বীর মুক্তিযোদ্ধার পরিবার ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বাবদ ৩৮৬৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। আগামী অর্থবছরে এ খাতে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হতে পারে।