‘ঘুম থেকে উঠে দেখি বন্ধুরা সবাই লাশ’
'মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া ঝর্ণায় প্রায় দুই ঘণ্টা ছিলাম আমরা। দুপুর একটার কিছুক্ষণ আগে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হই। সবাই ক্লান্ত ছিলাম, গাড়ি ছাড়ার পরপরই আমি ঘুমিয়ে পড়ি। হঠাৎ তীব্র শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায়, সেসময় একটা ট্রেন আমাদের মাইক্রেবাসটিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো চারদিকে কেয়ামত চলছে। যতক্ষণে ট্রেন থেমেছে, ততক্ষণে দেখি বন্ধুরা সবাই লাশ।'
শুক্রবার বিকেলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে কথাগুলো বলছিলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিউরো সার্জারি ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন শিক্ষার্থী তাসমির হাসান হৃদয় (১৮)।
চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বড়তাকিয়া ক্রসিং পার হওয়ার সময় তাদের মাইক্রোবাসে ট্রেনের ধাক্কায় আহতদের একজন তারা।
ঘটনার বিভীষিকার বর্ণনা দিয়ে তাসমির বলেন, 'ট্রেন যখন মাইক্রোবাসকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো। তখন শুধু একটানা কানে ঝিম ধরানো একটা শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছে সেই শব্দটা এখনো শুনছি, যা আমি কখনোই ভুলবো না।'
তাসমির চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি পলিটেকনিক্যালের শিক্ষার্থী ও হাটহাজারী উপজেলার আমানবাজার এলাকার বাসিন্দা। ২০২১ সালে এসএসসি পাশ করলেও বন্ধুদের সঙ্গে তিনিও পিকনিকে অংশ নিয়েছিলেন।
তার মা লাকী আক্তার টিবিএসকে বলেন, 'দু'দিন আগে বন্ধুদের সঙ্গে পিকনিকে যাওয়ার জন্য আমার কাছ থেকে এক হাজার টাকা চেয়ে নিয়েছিলো। দুপুর ১২ টার দিকে ফোনে কথাও হয়েছে। পিকনিকে টাকা দিয়েই আমি হয়তো পাপ করেছি। আজ আমার সন্তান মৃত্যুশয্যায়।'
শুধু তাসমির নয়, মিরসরাইয়ে রেল ক্রসিং দুর্ঘটনায় আহত হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মুত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন ছয়জন। যাদের সবার বয়সই ১৫ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে।
তাদের মধ্যে পাঁচজন 'আর অ্যান্ড জে কোচিং সেন্টার' নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ছাত্র ও একজন মাইক্রোবাসের হেলপার।
কিস্তির টাকায় কোচিং সেন্টার দিয়েছিলেন সজিব
জিয়াবুল হক সজিব (২৫) ও রিদওয়ান (২৪) দুজনই আমানবাজার এলাকায় 'আর সি এইচ' নামে একটি কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করতেন। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দুই বন্ধু মিলে আমানবাজারের যুগিরহাট এলাকায় নিজেদের দুজনের নামের অর্ধাক্ষর দিয়ে 'আর এন্ড জে প্রাইভেট কেয়ার' নামে নতুন কোচিং সেন্টার চালু করেন।
প্রতিষ্ঠানটি চালুর জন্য মুদি দোকানদার বাবার মাধ্যমে কিস্তিতে টাকা নেন সজিব। ইচ্ছে ছিলো সংসারের হাল ধরবেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর পূ্রণ হবে না।
'আর এন্ড জে প্রাইভেট কেয়ার' ২০২২ সালের এসএসসির শিক্ষার্থীদের বিদায় উপলক্ষে তাদের নিয়ে মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া ঝর্ণায় বেড়াতে যায়। সজিবসহ সাথে ছিলেন চার শিক্ষক। কিন্তু তারা কেউ ফেরেন নি।
নিহত বাকি শিক্ষকরা হলেন- উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র রাকিব, চট্টগ্রাম কলেজের ডিগ্রির শিক্ষার্থী রিদোয়ান ও চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের বিবিএ-র ছাত্র জিসান।
সজিবের বাবা মোহাম্মদ হামিদ কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, 'ছেলেটা মেধাবি ছিল আমার। ২০১৮ সালে ওমরগণি এমইএস বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের গণিত বিভাগে ভর্তি হলেও টাকার অভাবে দ্বিতীয় বর্ষে ভর্তি হতে পারেনি। পরে বন্ধুদের সঙ্গে মিলে কোচিং সেন্টার চালু করে, এ জন্য কিস্তিতে টাকা নিয়ে দিয়েছিলাম।'
এ ঘটনায় নিহত শিক্ষক মোস্তফা মাহমুদ রাকিবের চাচা সারওয়ার হোসাইন খান টিবিএসকে বলেন, 'আমার ভাইয়ের দুই সন্তান। রাকিব ছিল বড় ছেলে। উচ্চমাধ্যমিকের পড়ার পাশাপাশি কোচিংয়ে পড়াতো অনেকটা শখের বসেই। এমন একটা ঘটনা ঘটে যাবে কল্পনাও করিনি।'
এ দুর্ঘটনায় গুরতর আহত হয়েছেন মাইক্রোবাসের হেলপার তৌকির ইবনে শাওন। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন তৌকিরের মাথার জখম গুরুতর।
তৌকিরের ভাবি রুমা বেগম বলেন, 'মা মরা ছেলে; আমিই মাযের মত করে লালনপালন করছিলাম। গতবছর লকডাউনে এসএসসি পাশ করে গাড়ি চালানো শিখছিল। সকালে বের হওয়ার সময় আমার সঙ্গে কথা হয়। বলেছিল বিকেলে ফেরার সময় বাসার জন্য বাজার করে নিয়ে যাবে।'
মাইক্রোবাসটিকে এক কিলোমিটার ঠেলে নিয়ে যায় ট্রেন, রেললাইন জুড়ে তাণ্ডবলীলার চিহ্ন
ঘটনাস্থল ঘুরে আসা মিরসরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কবির হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'পর্যটকবাহী মাইক্রোবাসে ধাক্কা দেওয়ার পর ট্রেনের ইঞ্জিনের সঙ্গে আটকে যায় গাড়িটি। এভাবেই গাড়িটিকে দুর্ঘটনাস্থল থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দুরে ঠেলে নিয়ে যায় ট্রেন।'
'এ সময় পুরো রেললাইন এলাকায় চলে তাণ্ডবলীলা। এতে দুমড়ে–মুচড়ে গেছে মাইক্রোবাসটি। বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে শিক্ষাথীদের জামা, জুতা, ব্যাগ। দুর্ঘটনাকবলিত গাড়িটি কেটে কেটে আহত-নিহতদের বের করতে হয়েছে।'
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিউরো সার্জারি বিভাগের সহকারী রেজিষ্টার ডা. মোহাম্মদ কামাল হোসেন বলেন, 'আহতদের সবার মাথায় গুরুতর আঘাত আছে। এছাড়া পরিট্রমা ও অর্থোপেডিক্সের সমস্যা আছে। অনেকে চোখ, মাথা ও হাতে গুরুতর আঘাত পেয়েছেন।'
২৪ ঘণ্টার আগে তাদের শারিরিক পরিস্থিতি কী তা বলা যাচ্ছেনা- যোগ করেন তিনি।