এক গ্রামে ৩৬৫টি পুকুর!
লাইলি-মজনু ও শিরি-ফরহাদের প্রেমকাহিনি বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। মোগল সম্রাট শাহজাহান তার স্ত্রী মমতাজকে ভালোবেসে বানিয়েছিলেন তাজমহল।
জনশ্রুতি আছে, অষ্টম শতাব্দীর পাল বংশের রাজা চান্দিলাল পাল। স্ত্রীর প্রতি তার ছিল অগাধ ভালবাসা। তাই স্ত্রীর আরোগ্য লাভের জন্য তিনি ৩৬৫টি পুকুর খনন করেছিলেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। এসব পুকুর নিয়ে রয়েছে নানান গল্প। যা রূপকথার মতোই মনে হতে পারে।
নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার ইসবপুর ইউনিয়নের প্রত্যন্ত চক-চান্দিরা গ্রাম। এ গ্রামে প্রায় ৮ কিলোমিটার বিস্তৃত পাশাপাশি ছোট-বড় ৩৬৫টি পুকুর রয়েছে। লোককথা বা রূপকথা, যা-ই হোক না কেন প্রতিদিনই ওই গ্রামে আসছে পর্যটক। বর্তমানে এ গ্রামটি রাস্তাঘাটের উন্নয়নসহ পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় এলাকাবাসী ও জনপ্রতিনিধি। গ্রামটি দর্শনীয় স্থান হিসেবে পরিচিতি পাবে এমন প্রত্যাশা স্থানীয়দের। এতে এলাকার শিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি আর্থসামাজিকের উন্নয়ন হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
জেলা শহর থেকে উত্তরে ধামইরহাট উপজেলার দূরত্ব প্রায় ৫০ কিলোমিটার। আর ধামইরহাট উপজেলা সদর থেকে দক্ষিণে ১৬ কিলোমিটার দূরে প্রকৃতিতে ঘেরা ছায়া সুনিবিড় ঘুকশি নদীর তীরে গ্রাম চক-চান্দিরা। তবে জেলা শহর থেকে বদলগাছী উপজেলা হয়ে উত্তরে মাত্র ৩৫ কিলোমিটার দুরে চক-চান্দিরা গ্রাম। গ্রামে প্রবেশপথে দেখা যাবে মাটির রাস্তার দুধারে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ, আর মাটির ও আধাপাকা ইটের বসতবাড়ি। এ গ্রামে রয়েছে সারি সারি ছোট-বড় পুকুর। পুকুরগুলো পূর্ব-পশ্চিম ও উত্তর-দক্ষিণ লম্বা। আবার কিছু পুকুর চার কোনাকৃতি।
অষ্টম শতাব্দীর পাল বংশের কোনো এক রাজার রাজ্য ছিল ওই গ্রামে। কোন রাজার রাজ্য ছিল, তার সঠিক ইতিহাস কোথাও লিপিবদ্ধ নেই বা পাওয়া যায়নি।
লোককথা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীর পাল বংশের রাজা চান্দিলাল পাল তার স্ত্রীকে খুব ভালোবাসতেন। তার স্ত্রী হঠাৎ কঠিন রোগে আক্রান্ত হন। স্ত্রী যেন আরোগ্য লাভ করে, সেজন্য রাজ দরবারে হেকিম, কবিরাজ ও বৈদ্যের নিয়ে রাজদরবারে সভা হয়। হেকিমরা রাজাকে স্ত্রীর রোগ থেকে মুক্তিলাভে ৩৬৫টি পুকুর খনন করার পরামর্শ দেন। রানি প্রতিদিন পৃথক পুকুরে স্নান করবেন। এতে তিনি রোগ থেকে মুক্তি মিলবে। হেকিমদের পরামর্শে রাজা পুকুরগুলো খনন করেন। প্রতিটি পুকুরে ৩-৪টি শান বাঁধানো ঘাট তৈরি করা হয়।
এসব পুকুর ঘিরে প্রচলিত আছে নানা কুসংস্কার। লোকশ্রুতি অনুসারে, রাজা তার দুই স্ত্রীর জন্য আলাদা আলাদা পুকুর খনন করে দিয়েছিলেন। যা পরবর্তীতে দুই সতীনের পুকুর নামে পরিচিতি পায়। আরেক কুসংস্কার অনুসারে, পুকুরে পাথর একা একা চলাফেরা করত বলে একে পাথর পকড়া নামেও ডাকা হয়। বর্তমানে এখানে রাজপ্রসাদ বা অন্য কোনো ধ্বংসাবশেষ চোখে পড়ে না। কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে সেসব ইতিহাস। কালের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে পুকুরগুলো। মানুষের মুখে মুখে আজও রয়ে গেছে সেসব লোককথা।
পুকুরগুলো পাড় ঘিরে সবুজ বনায়ন করেছে বন বিভাগ। গড়ে উঠেছে বসতবাড়ি। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হলে নয়নাভিরাম সৌন্দর্য দর্শনার্থীদের জন্য আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে।
আরও ধারণা করা হয়, বরেন্দ্র এলাকা হওয়ায় পাল আমলে সে সময় পানির তীব্র সংকট ছিল। পানির চাহিদা মেটাতে রাজা বা শাসকরা তাদের নিবাসের আশপাশে পুকুর খনন করতেন। দূর-দূরান্ত থেকে পুকুরে পানি সংগ্রহের জন্য আসত প্রজারা।
চক-চান্দিরা গ্রামের বাসিন্দা আনিছুর রহমান বলেন, 'একাত্তরের আমরা এ গ্রামে ভারত থেকে চলে আসি। সে সময় এখানে শুধু গাছ ও জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। আর পুকুরগুলো আজও আছে। প্রায় ৮ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ৫টি সারিতে পুকুরের অস্তিত্ব রয়েছে। প্রতিটি পুকুরে ছিল ৩-৪টি শানবাঁধানো ঘাট। এখন সেই ঘাটগুলো দেখা যায় না। আমরা এক সময় পুকুরগুলো ব্যবহার করতাম। ...মানুষ এখন আধুনিক হয়ে গেছে। নলকূপ ও সাবমার্সিবল পাম্প বাড়িতে বসানোর কারণে পুকুর তেমন আর ব্যবহার করে না। পুকুরগুলো সরকার থেকে ইজারা নিয়ে অনেকেই মাছ চাষ করছেন।'
স্থানীয় যুবক ইমন হোসেন ও লিটন বলেন, 'গত ঈদুল ফিতর থেকে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আমাদের গ্রামে পুকুর দেখতে আসছেন। পুকুর পাড়ে বনায়ন থাকায় তাদের কাছে ভালো লাগে। যদি আমাদের এলাকাটি পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা হয়, তাহলে শিক্ষিত বেকার যারা আছি তাদের কর্মসংস্থান হতো। এছাড়া এলাকার অনেক উন্নয়ন হতো।'
স্থানীয় ইসবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহফুজুল আলম লাকী বলেন, 'আর কোথাও একই গ্রামে এতগুলো পুকুর আছে কি না আমার জানা নেই। চক-চান্দিরা গ্রামটি অবহেলিত। সেখানের যোগাযোগ ব্যবস্থাও খুবই খারাপ। রাস্তা মাটির হওয়ায় পর্যটকরাও ঠিকমতো আসতে পারেন না। সামান্য বৃষ্টিতে কাদা হয়ে যায়। আর যারা আসেন তারা কষ্ট করেই সেখানে যান। গ্রামটি পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তুলতে সর্বপ্রথম রাস্তা পাকাকরণ করা জরুরি। এছাড়া পর্যটকদের বিনোদনের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। পুকুরকে কেন্দ্র করে গ্রামটি পর্যটন এলাকা হলে শিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থান হবে। পাশাপাশি এলাকার আর্থসামাজিক উন্নয়ন হবে।'
চক-চান্দিরা গ্রাম প্রাচীন জনপদের ইতিহাস প্রসিদ্ধ বরেন্দ্র অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করেন ইতিহাসবিদ ও ধামইরহাট এমএম ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ মো. শহীদুল ইসলাম। তিনি বলেন, 'ইতিহাস থেকে জানা যায়, ঘুকশি নদী একসময় প্রবল প্রমত্ত নদী হিসেবে পরিচিত ছিল। এ নদীটি আত্রাই নদীর আদিশাখা। যা ছোট যমুনা নদীর নিম্নভাগ এবং দক্ষিণে ত্রিমোহনীতে গিয়ে মিলিত হয়েছে। সেখান থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দুরে চক-চান্দিরা গ্রাম। এ গ্রামটি প্রাচীন সভ্যতায় উন্নত সমৃদ্ধ একটা নগরী। যেখানে প্রাচীন দালান কোঠা, রাস্তা-ঘাট ও জনপদ ছিল বলে ধারণা করা হয়।
'ওই গ্রামে যেসব পুকুর খনন করা হয়েছিল বর্তমানে তার ৩৬৫টি পুকুরের অস্তিত্ত্ব পাওয়া যায়। কোন রাজার আমলে এবং কখন পুকুরগুলো খনন করা হয় তার সঠিক ইতিহাস কোথাও লিপিবদ্ধ নেই বা পাওয়া যায়নি। তবে ধারণা করা যায়, পাল যুগের পূর্বে অষ্টম শতাব্দীতে হিন্দু শাসনামলে ওই এলাকায় একটি রাজবাড়ির অস্তিত্ব ছিল। সেই রাজবাড়ির রাজা বা অন্য কোন রাজার ইতিহাস লোকমুখে বা বংশপরম্পরায় আমরা শুনে আসছি।'
নওগাঁ জেলা প্রশাসক মো. খালিদ মেহেদী হাসান বলেন, 'ধামইরহাট উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকায় অনেকগুলো পুকুর রয়েছে। ওই এলাকার পরিবেশ অত্যন্ত মনোরম। এই স্থানটিকে একটি পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার সম্ভাবনা রয়েছে। এলাকাটিকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে এবং আর্কষণীয় করতে ইতোমধ্যে বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।'