বিআরটি’র প্রকল্পে মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে ঢাকার প্রধান সড়ক
সম্প্রতি এক সন্ধ্যায়, মাহফুজ তার বাইকে একজন যাত্রী নিয়ে রাজধানী উত্তরায় এক বন্ধুর বাড়িতে যাচ্ছিলেন।
এয়ারপোর্ট পার হওয়ার পরই তার বাইকটি রাস্তার ওপর ধাক্কা খায়। রাস্তার অমসৃণতার কারণে ধাক্কা খেয়েছিল তার বাইকটি। মাহফুজ জানায়, রাস্তার একপাশ অন্যপাশের চেয়ে কমপক্ষে ৬ ইঞ্চি উঁচু ছিল এবং জায়গাটি আলাদা রঙ ব্যবহার করে চিহ্নিত করা ছিল না। শুধু তাই নয়, কম আলোর কারণে রাস্তাটি যে অসমান, তা বোঝাও যাচ্ছিলনা।
ধাক্কা খেয়ে মাহফুজ ও পিছনে বসে থাকা যাত্রী, দুজনেই রাস্তায় পড়ে গিয়ে মারাত্মভাবে আহত হন।
বাইকের পিছনে থাকা যাত্রীর পায়ের বেশ কিছু জায়গায় ভেঙ্গে যায় এবং তাকে হাসপাতালে আনা হলে ডাক্তার তার পা কেটে ফেলার পরামর্শ দেন। মাহফুজও গুরুতরভাবে আহত হন, কিন্তু শরীরের কোনো হাড় ভাঙেনি তার।
মাহফুজ বলেন, "রাতে আলো কম থাকার কারণে, আমি রাস্তার অসমতা দেখতে পাচ্ছিলাম না। রাস্তা ব্যবহারকারীদের জন্য সেখানে কোনো সতর্কতামূলক চিহ্নও ছিল না।"
এছাড়া, রাস্তায় বালি এবং ইট-পাথর ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল, যার ফলে শুধু বাইকই নয়, যেকোনো যানবাহন উল্টে যেতে বা নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে বলে উল্লেখ তিনি।
একজন পুলিশ অফিসারকে উদ্ধৃত করে বাবু বলেন, "আমার দুর্ঘটনার মাত্র কয়েক সেকেন্ড পরে, আরেকজন বাইকার একই জায়গায় ধাক্কা খেয়ে অজ্ঞান হয়ে যান।"
রফিকুল ইসলাম নামে আরও এক চালক বলেন, উত্তরার কিছু জায়গায় রাস্তার উপরিভাগ এতটাই এলোমেলো যে, খুব সাবধানে না চালালে গাড়ি সহজেই উল্টে যেতে পারে।
উত্তরায় চলমান বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) লাইন-৩-এর চলমান কাজের কারণে ওই এলাকার সড়কের এখন বেহাল দশা। অথচ প্রকল্প এলাকার রাস্তা রক্ষণাবেক্ষণ করা প্রকল্প কর্তৃপক্ষেরই দায়িত্ব।
ঢাকা বিআরটি কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সফিকুল ইসলাম বলেন, "আমরা এখন নিরাপত্তার বিষয়টিতে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। প্রকল্প এলাকার চারপাশে রাস্তার গর্ত, বাম্প এবং অসমতা ঠিক করা হচ্ছে। উঁচু ও নিচু রাস্তার মধ্যে ডিভাইডার নির্মাণ করা হবে। ট্রাফিক সাইনসহ সতর্কতা চিহ্ন বসানো হবে।"
এদিকে, বিআরটি প্রকল্প কর্তৃপক্ষের গাফিলতিতে ইতোমধ্যেই ঘটেছে বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনা, যেখানে প্রাণ হারিয়েছে অন্তত ছয়জন। সর্বশেষ ১৫ আগস্ট দুর্ঘটনায় উত্তরা বিআরটি-৩ প্রকল্পের গার্ডার যাত্রীবাহী প্রাইভেট কারের ওপর পড়ে গিয়ে ঘটনাস্থলে একই পরিবারের পাঁচজন নিহত এবং দুজন আহত হন।
বিআরটি প্রকল্পের দীর্ঘদিন ধরে টানা চলতে থাকা কাজের কারণে সড়ক ব্যবহারকারীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। ২০১২ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) ২ হাজার ৪০ কোটি টাকার এই প্রকল্প অনুমোদন দেয়। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও দুটি ধাপে ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয় কাজ শেষ হওয়ার সময়সীমা।
২০২০ সালের মধ্যেও কাজ শেষ না হওয়ায় চলতি বছরের জুন পর্যন্ত আবারও মেয়াদ বাড়ানো হয়। এরই মধ্যে প্রকল্পের বাজেট সংশোধিত হয়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ২৬৮ কোটি ৩২ লাখ টাকায়।
কিন্তু তৃতীয় ধাপে নির্ধারিত নতুন সময়সীমার মধ্যেও শেষ হয়নি কাজ। আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সব কাজ শেষ হবে বলে আশা করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
অন্যান্য প্রকল্পেও উপেক্ষিত সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টি
ঢাকায় চলমান আরেকটি মেগা প্রকল্প হলো মেট্রোরেল প্রকল্প। এই প্রকল্পের কারণেও সড়ক নিরাপত্তা ব্যাহত হচ্ছে। প্রকল্প সংলগ্ন সড়কে বিশেষ করে কারওয়ানবাজার ও বিজয় সরণি এলাকায় প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে।
ইট-পাথর, নুড়ি, বালি, এবং কাদা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে রাস্তার ওপরে। এতে সড়ক এতটাই পিচ্ছিল হয়ে যায় যে, বাইকারসহ অন্যান্য যানবাহনের চালকরা ব্রেক চাপার সঙ্গে সঙ্গেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন।
ভুক্তভোগী মোঃ হুমায়ুন বলেন, "৩০ জুলাই রাতে অফিস থেকে বাড়ি যাচ্ছিলাম। বিজয় সরণি পেরিয়ে আগারগাঁওয়ের দিকে যাওয়ার সময় আমাকে হার্ড ব্রেক করতে হয় এবং রাস্তায় ছড়িয়ে থাকা ছোট নুড়ির কারণে বাইকের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। এতে সঙ্গে সঙ্গেই বাইক নিয়ে আমি মাটিতে পড়ে যাই।"
"তুলনামূলকভাবে ধীরে চালানোর কারণে আমি গুরুতর আঘাত থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছি। তবে আমার ডান হাতের কনুই ভেঙে গেছে," যোগ করেন হুমায়ুন।
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের কোম্পানি সেক্রেটারি মোহাম্মদ আবদুর রউফ বলেন, "কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা রাস্তা মেরামত করার চেষ্টা করি। আমরা বুঝি রাস্তার বেহাল দশার কারণে মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। এখন থেকে আমরা প্রকল্প এলাকার কাছাকাছি যান চলাচলের জন্য রাস্তা পরিষ্কার ও নিরাপদ রাখার ব্যাপারে আরও সতর্ক হবো।"
এছাড়া, রাজধানীর বিভিন্ন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান সারাবছরই রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করে উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করে থাকে। সড়কে নির্মাণসামগ্রী রেখে পথচারী ও যান চলাচলের নিরাপত্তা দিতেও তারা উদাসীন।
কর্তৃপক্ষের এমন অবহেলার শিকার হয়েছেন, এমন বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।
ক্ষোভ প্রকাশ করে তারা বলেন, একটি প্রকল্প এলাকার কাছাকাছি রাস্তাগুলো এমন অবস্থায় রাখা হয়েছে, যেখানে যেকোনো দুর্ঘটনা সময়ের ব্যাপার মাত্র। বেশিরভাগ দুর্ঘটনাই রিপোর্ট করা হয়নি; কারণ ভুক্তভোগীরা বিষয়টিকে খুব বেশি ঝামেলাপূর্ণ বলে মনে করেন।
দূরপাল্লার বাস ও নৌযান চলাচলকারী পরিবহন কোম্পানি গ্রীন লাইনের মহাব্যবস্থাপক মোঃ আবদুস সাত্তার বলেন, "রাস্তায় খোলা ম্যানহোল রয়েছে। এ ধরনের গর্তে ধাক্কা লেগে যানবাহনের চাকা ও সাসপেনশন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বা ভেঙে যেতে পারে। মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটারও সম্ভাবনা রয়েছে।"
বার বার অভিযোগ আসা সত্ত্বেও, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ দুই সিটি কর্পোরেশন এসব সমস্যা সমাধানে কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
ঢাকা উত্তরের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ সেলিম রেজা বলেন, "আসলে আমরা সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে কিছু শর্তে অনুমতি দিয়ে থাকি; এরমধ্যে রয়েছে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করা এবং এমনভাবে কাজ পরিচালনা করা যাতে জনদুর্ভোগ কম হয়।"
তবে, তাদের মধ্যে অনেকে মাঝেমধ্যেই শর্ত ভঙ্গ করে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
"কখনও কখনও আমরা কারণে পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হই, কিন্তু আমরা সড়ক নিরাপত্তা ইস্যুতে কঠোর হচ্ছি। শহরে কোনো জনদুর্ভোগ হতে দেওয়া হবে না," যোগ করেন ঢাকা উত্তরের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা।